ফাগুন মাস এখনো শেষ হয়নি। শেষ হয়নি কোকিলের কুহুতান। আর এরই মাঝে শুরু হল মার্চ মাস। অগ্নিঝরা মার্চ মাস। সংগ্রাম আর স্বাধীনতার সূতিকাগার এই মার্চ মাস। নতুন একটা স্বপ্ন বোনা, নতুন একটা স্বপ্ন দেখার মাস। অন্যায়, অবিচার, পরাধীনতা আর জুলুমের শৃংখল থেকে মুক্তির নিশান ওড়ানোর মাস। মার্চ মাস।

স্বাধীনতার মাস। স্বাধীনতা শব্দটি আপেক্ষিক। কিন্তু এর গভীরতা সুদূর। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু তৎকালীন সামরিক গোষ্ঠী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে। সেই অবস্থা দেখেই বাঙালিরা নিজেদেরকে জোটবদ্ধ করতে থাকে স্বাধীনতার জন্যে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালের ৩ই মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের জন্য তারিখ নির্ধারিত করে। আর গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো। এ কারণে পূর্বঘোষণা ছাড়াই পহেলা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করা হয়। এই ঘোষণায় পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। ঢাকা পরিণত হয় বিক্ষোভের নগরীতে। শেখ মুজিবুর রহমান ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সারাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলতে তৎপরতা চালায়।

২ মার্চ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বহু ঘটনা আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে স্মরণীয় হয়ে আছে। ৭ মার্চ ছিল রোববার। শেখ মুজিবুর রহমান দেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। এটি ছিল এক আবেগি প্লাবিত এবং হৃদয় উদ্বেলিত করা ভাষণ। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী জনতার যে ঢল নেমেছিল তা ছিল অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। জনসমুদ্রে আগমনকারী জনতা ছিল নিশ্চুপ, রাজনীতির কবির কন্ঠে তেজোদীপ্ত বাণী এবং নির্দেশ শোনার অপেক্ষায়। আর এভাবেই শুরু। মুক্তির বাসনা উথলে উঠল লাখো বাঙালির মনে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। দিন দিন অবস্থার অবনতি ঘটে। মানুষ মুক্তির নেশায় পাগল হয়ে ওঠে। জারি হয় কারফিউ। অবশেষে আসে সেই ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর ভয়াল কালো রাত । অপারেশন সার্চলাইট নামের দমন অভিযানে সেনা ভর্তি গাড়ি ও ট্যাংকগুলো ক্যান্টনমেন্ট থেকে নেমে আসে ঢাকার রাস্তায়। শুরু হয় তান্ডব। নির্বিচার গণহত্যা। আবাল- বৃদ্ধ- বণিতা থেকে শুরু করে রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটিও রক্ষা পায়নি তাদের হাত থেকে। হাজারো মানুষের লাশ পড়ে সে রাতে। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হত্যাকা-গুলের মধ্যে এটি একটি।

পরদিন ২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জানা যায়, গ্রেফতারের আগে তিনি ঘোষণা করে যান বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পরাধীনতা আর শোষণের কবল থেকে মুক্ত হতে বাংলার তরুণ-যুবকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে। আর এভাবেই রচিত হয় ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধের পর বিশ^ মানচিত্রে অংকিত হয় এক নতুন দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ।

আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আর দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ এই পঁয়তাল্লিশ বছরেও ক্ষত পুরো শুকায়নি। ইতিহাসের ভাঁজে জমে থাকা অনেক অধ্যায়ের উন্মোচন হয়নি। উপেক্ষিত রয়ে গেছে অনেক বীরত্বগাথা। মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা এবং অংশগ্রহণ আজও রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে। কোন এক অজানা কারণে আজ তাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে দেশ।

১৯৭১ সালে ‘মোনাফিকদের ক্ষমা নেই’ শীর্ষক একটি সরকারি প্রচার পত্রের শেষে লিখা ছিল, আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘সত্যের জয় ও মিথ্যার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, বাঙালি এতে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী।’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র : ৩য় খ-, পৃ. ৩৩২- ৩৩৬) এভাবেই শুরু হয় যুদ্ধের। স্বাধীনতা সংগ্রামের। অংসখ্যা আলেম, ওলামা সেই সময় এই সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। পাকিস্তানিদের শোষণ আর জুলুমের বিরুদ্ধে তাদের ছিল সোচ্চার ভূমিকা। কিন্তু সেই ঘটনাগুলো অনেকটা ইচ্ছে করেই আড়াল করে ফেলা হচ্ছে।

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের বিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাসে আসা যাক। তিনি তার উপন্যাসে সাফিয়া বেগমের কথা উল্লেখ করেছেন। সাফিয়া বেগম উনার ছেলে আজাদকে পুরান ঢাকার জুরাইন পীরের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই জুরাইন পীরের অনেক মুরিদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন অসংখ্য উলামায়ে কেরাম। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন আল্লামা হাফেজ্জী হুজুর, আল্লামা লুৎফুর রহমান বরুণী, আল্লামা কাজী মুরতাসিম বিল্লাহ, আল্লামা মুফতি নুরুল্ল্যাহ, আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী, আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী।

বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাগুলোর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় মাদরাসা হল চট্রগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসা। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মেজর জিয়াউর রহমান এই চট্রগ্রামের পটিয়া মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করে। তারা যখন নিশ্চিত হয় যে পটিয়া মাদরাসার আলেমরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে, তখনি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেই পটিয়া মাদরাসার উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা বর্ষণ করা শুরু করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই বোমা বর্ষণে পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশ ও ক্বারী জেবুল হাসান সহ অনেকেই শহীদ হন। (বেলাল মোহাম্মদ : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র : পৃষ্ঠা – ৫৪,৫৫ ও ১০২)

শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে এই দেশে ভারতের দেওবন্দ মাদরাসা কেন্দ্রিক যে আলেমদের সংগঠন ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ ছিল তারাও কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অনেক ফতোয়া দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রধান মুহাদ্দিস শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ. পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন । পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার উনাকে জোর করে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর উনি বাংলাদেশে ফিরলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান খতীব হিসাবে নিযুক্ত করেন। (শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ. এর জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সবচেয়ে বড় কওমী মাদরাসার প্রধান মুহতামিম আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অনেক বড় বড় আলেম। তার ফতোয়া শুনে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আল্লামা তাজুল ইসলাম নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। (ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ও উনার সাথীবর্গ, লেখক – হাফিয মুহাম্মদ নুরুজ্জামান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)

এমন হাজারো উদাহরণ টানা যেতে পারে যারা অন্যায়, অত্যাচার আর দেশকে স্বাধীন করতে নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় আজ তারা কালের গর্ভে বিলীন। কষ্ট হলেও সত্যি অনেকটা ইচ্ছে করেই তাদেরকে এড়িয়ে গেছে ইতিহাসের এই পথ চলা। আজও মূল্যায়ন হয়নি তাদের এই বিসর্জন। তাই এই স্বাধীন বাংলা কতটুকু স্বাধীন এ প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।

পাকিস্তান এদেশকে শোষণ করেছিল। চুষে খেয়েছিল আমাদের দেশের সবকিছুই। আমরা তখন স্বপ্ন দেখেছিলাম একটি স্বাধীন দেশের। কিন্তু আজ স্বাধীন দেশে বসবাস করেও আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। বছরের পর বছর এ দেশকেও চুষে খাচ্ছে জনগণ নির্বাচিত-অনির্বাচিত সরকার। স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া মানুষগুলো এখন জীবন বাচাঁতে ব্যস্ত। দুর্নীতিতে পরপর পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ান হওয়া এ দেশ এখনো দুর্নীতিগ্রস্ত রয়ে গেছে। আজও আমরা সেই শোষণ থেকে মুক্ত হতে পারিনি।

গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। যা আমাদের দেশের এক অর্থ বছরের বাজেটের চেয়েও কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি। টাকা পাচার বন্ধে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিয়ে টাকা পাচার বন্ধ করা যাবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে যে সমস্ত কারণে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় হয় না, পুঁজিবাজার লুটপাটের কোনো বিচার হয় না, ঠিক একই কারণে টাকা পাচারেরও কোনো সমাধান হবে না। কারণ, যে ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আমরা জানি তাঁরা খুবই শক্তিশালী। কেবল প্রশাসনের পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব হবে না।’

বড় আশ্চর্য লাগলেও বিষয়গুলো এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। আর এগুলো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হচ্ছে। সেই ’৭১ পূর্বেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল একবার বলেছিলেন, শেয়ারবাজারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাট হয়েছে। সরকার রোড শো করে সাধারণ মানুষকে পুঁজিবাজারে টেনে এনে এই লুটপাটের আয়োজন করেছে।

আজ আমরা স্বাধীন বাংলার পরাধীন জাতি। আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। নিজ ঘরে সংসদ সদস্য হত্যা হচ্ছে। হত্যা করছে প্রাক্তন সাংসদ। নিরাপত্তা আজ কোথায়? আমাদের সাধারণ নাগরিকদের অবস্থা আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কেউ সকালে ঘর থেকে বের হলে সন্ধ্যায় নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসবে এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। জনসাধারণের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃংখলা বাহিনীর অবস্থা তথৈবচ। নারায়ণগঞ্জে সাত খুন একটি আলোচিত বিষয়। সবারই কম বেশি জানা। আর এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। যাদের কাছে মানুষ আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করে তারাই যদি মানুষ হত্যা করে তবে পাকিস্তানি শোষকদের সাথে আমাদের অমিল কোথায়!

আইনশৃংখলা বাহিনীর অপকর্ম আজ নতুন নয়। জনসাধারণকে নানানভাবে হয়রানির আরেক নাম এই পুলিশ বাহিনী।
প্রশ্নপত্র ফাঁস, হরতাল, অবরোধ, মানুষকে নির্বিচারে হত্যা, মূল্যবৃদ্ধি, সীমান্তে হত্যা এমন হাজারো সমস্যার মাঝে থেকেও আমরা স্বাধীন বাংলার নাগরিক। আজ আমাদের পূর্ণ বাক-স্বাধীনতাও নেই। কোথায় কি বলতে হবে, কি বলা যাবে কি যাবে না, কাকে কতটুকু বলা যাবে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে দেয়া হয়। এর বাইরে কিছু হলে সাজা হয়ে যায়। নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ের উপরেও। আর এই নিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়ে এই লেখাতে অনেক কিছুই বলা গেল না। তবুও আমরা বেঁচে আছি। স্বপ্নহীন এক পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে আছি। ’৭১ পূর্বেও আমরা বেঁচে ছিলাম। প্রকৃত বাঁচা সে বেঁচে গেছে যে ওপারে চলে গেছে। শৃংখলাবদ্ধ এই দু’অবস্থার কোন ফারাক নেই। ফারাক শুধু এতটুকুই কাগজে কলমে। আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক।

লেখক
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট