মুহাম্মাদ আবদুল ওয়াহাব : হক-বাতিলের দ্বন্ধ চিরন্তন। হক যেখানে বিজয়ী, বাতিল সেখানে পরাজিত। হক আলোর দিশারী, বাতিল অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি। ইসলামী বিপ্লবের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে হক-বাতিলের লড়াই ঘটেছে। ইসলাম হকের ঝান্ডাবাহী। তাই যেখানেই ইসলাম তথা খোদায়ী আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হতে শুরু করেছিল, সেখানেই বাতিল তার পেশি শক্তি ব্যবহার করে হক-কে দমাতে চেয়েছে। হক-বাতিল তথা ইসলাম ও কুফরের ঐতিহাসিক এক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই ঘটেছিল ১৭ই রমযান, দ্বিতীয় হিজরী তথা ১৩ মার্চ, ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা. ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে মনোনিবেশ করেন। বিশ্বনবী সা. কে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেই কাফের সম্প্রদায় ক্ষান্ত হয়নি, বরং ইসলাম যাতে বিকশিত না হতে পারে সেজন্য তারা মদীনায় ও রাসূল সা. কে ইসলাম প্রচার করতে না দিতে সংকল্পবদ্ধ হয়।
কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে ও জীবন রক্ষার্থে মহানবী সা. ও অন্য মুসলমানগণ মক্কা ছেড়ে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন। এর ফলে মুসলমানদের ওপর তাদের ক্ষোভ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনি মদীনাবাসীদের সাথেও তাদের শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে এ শত্রুতা আরও বেড়ে গেলে দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান (৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মার্চ) বদর প্রান্তরে মক্কার কুরাইশ ও মদীনার মুসলমানদের মধ্যে একটি যুদ্ধ হয়। এটি ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত।
বদর যুদ্ধের কারণ :
মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা: মক্কায় হযরত মুহাম্মাদ সা. কর্তৃক ইসলাম প্রচারিত হলে কুরাইশগণ এটিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। তাদের সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মাদ সা. মদীনায় হিজরত করার পর মাত্র দুই বছরের মধ্যে ইসলাম ধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে। সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে কুরাইশগণ ভীষণভাবে ঈর্ষান্বিত হয়। তারা মদীনার মুসলমানদের নাম-নিশানা ধরা থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। মহানবী সা. তাদের কার্যক্রমের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন।
ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ আলী বলেন, ‘ক্ষুদ্র মুসলীম সম্প্রদায়কে রক্ষার দায়িত্ব মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা. এর ওপর এসেছিল এবং তিনি একজন দক্ষ সেনানায়কের মতো শত্রুর গতিবিধি লক্ষ রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন’। ফলে কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি তিনি মোকাবিলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হন।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর ষড়যন্ত্র: খাযরাজ গোত্রের অন্যতম নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মদীনার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল মদীনার ভবিষ্যৎ শাসক হওয়া। কারণ, জাহিলি যুগে আওস ও খাযরাজ গোত্রের অব্যাহত শত্রুতা, হত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞে মদীনা তথা তৎকালীন ইয়াসরিববাসী বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত উভয় গোত্রের শান্তি প্রত্যাশী নেতারা তাদের মধ্যকার সর্বাধিক চতুর ও নেতৃত্বের যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে মনোনীত করে তাকে ইয়াসরিবের শাসক হিসেবে ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা তার জন্য একটি মুকুট ও তৈরি করে। কিন্তু মহানবী সা. এর মদীনায় হিজরতের ফলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর মদীনার শাসক হওয়ার স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায়। বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করলেও গোপনে সে কুরাইশদের সাথে ষড়যন্ত্র করে মহানবী সা. কে মদীনা থেকে বহিষ্কারের পরিকল্পনা করে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে মুনাফিক তথা নামধারী মুসলমানদের একটি দল গঠন করে। এরা বাহ্যিকভাবে ইসলামের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতো কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইসলামের বিনাশ সাধনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বহি:শত্রুকে মদীনা আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। মদীনার মুনাফিকদের এই তৎপরতা মক্কার কুরাইশদের মনোবলকে চাঙা করে। ফলে তারা মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
মদীনায় মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি: মদীনায় গিয়ে মহানবী সা. ‘মদীনা সনদের’ মাধ্যমে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মদীনায় তাঁর মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এ.এইচ সিদ্দিকীর মতে, “মদীনা সনদের ফলে হযরত মুহাম্মাদ সা. সর্বোচ্চ সামরিক, বিচারিক, প্রশাসনিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান হলে মদীনা রাষ্ট্র একটি শক্ত ভিত্তি লাভ করে।” ফলে মক্কার কুরাইশগণ মুসলমানদের এই অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে তাদের ধ্বংস করার জন্য মদীনা আক্রমণে অগ্রসর হলে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতা :
মদীনার ইহুদি সম্প্রদায় হযরত মুহাম্মাদ সা. কে তাদের রীতি-নীতিতে সায় দিবেন বলে মদীনায় গ্রহণ করে। কিন্তু ইসলামের সম্প্রসারণ ঘটলে তারা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। তাদের ধর্মীয় ও নাগরিক স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রায় দেওয়া সত্ত্বেও ইহুদিগণ কোনো দিনই মুসলমানদের অবস্থানকে ভালো দৃষ্টিতে দেখতে পারেনি। তারা মদীনা সনদে স্বাক্ষর করেও তা লঙ্ঘন করে মক্কার কুরাইশদের কাছে তথ্য পাচার করে এবং তাদেরকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করতে থাকে। লিপ্ত হয় নানামুখী ষড়যন্ত্রে।
তাই ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, “তখন সমগ্র মদীনা শহর ইহুদিদের বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরে গিয়েছিল।”
বাণিজ্যিক পথ রুদ্ধ হওয়ার আশংকা: সিরিয়া ও মক্কার বাণিজ্য পথে মদীনা অবস্থিত ছিল। কুরাইশরা এই পথে সিরিয়া, মিসর ও অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য করত। মহানবী সা. এর নেতৃত্বে মদীনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে কুরাইশগণ নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ হারাতে পারে এ আশঙ্কায় তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ড. এস.এম ইমামুদ্দীনের মতে, “একজন সত্যিকারে বিজ্ঞ সমরবিদ হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ সা. মক্কাবাসীদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার জন্য সচেতন হয়ে সিরিয়ার সাথে মক্কার ব্যবসা বন্ধ করার পরিকল্পনা করেন।”
কুরাইশদের দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ :
মক্কার কুরাইশরা পরিকল্পিতভাবে মদীনার সীমান্তে প্রায়ই লুটতরাজ করত। অন্যদের দিয়ে করাতো। তারা মুসলমানদের ফলের গাছ ধ্বংস ও গবাদি পশু ধরে নিয়ে যেত। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কুরজ বিন জাবিরের নেতৃত্বে একটি কুরাইশ বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে হামলা চালিয়ে কয়েকটি উট ধরে নিয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মদীনাবাসীদের উস্কানী দিয়ে বলতে থাকে, মুহাজিরদের বিতাড়িত না করলে কুরাইশরা মদীনা ধ্বংস করে দিবে। এজন্য মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মন্তব্য করেন, “ ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ধ্বংসের জন্য কুরাইশদের দীর্ঘদিনের উদ্যোগ ছিল বদরের যুদ্ধের কারণ।”
হযরত মুহাম্মাদ সা. কে আশ্রয়দান: মক্কাবাসীরা হযরত মুহাম্মাদ সা. কে দুনিয়া থেকে বিদায় করার সমস্ত আয়োজন সমাপন করার মধ্যেই মদীনাবাসীদের দ্বারা তিনি আশ্রয়প্রাপ্ত হন। এতে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়। তাই মদীনা রাষ্ট্রকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে তারা সমরায়োজনে মেতে উঠে।
নাখলার খণ্ড যুদ্ধ :
কুরাইশদের সাথে মদীনাবাসী মুসলমানদের প্রথম সংঘর্ষ ঘটে নাখলায়। কুরাইশগণ কর্তৃক সীমান্তে ধ্বংসাত্বক কার্যাবলী থেকে মদীনা রাষ্ট্রকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মহানবী সা. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ রা. এর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি গোয়েন্দা দল মক্কার উপকণ্ঠে প্রেরণ করেন। কিন্তু আবদুল্লাহ রা. ভুলক্রমে মক্কাগামী একটি কাফেলার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এত মক্কার আবদুল্লাহ আল হাজরামির পুত্র আমর নিহত হয়। মক্কার কাফিরদের মধ্যে এতে যুদ্ধের বাসনা তীব্রতর হয়ে উঠে।
আবু সুফিয়ানের মিথ্যা প্রচারণা: মুসলমানরা মদীনায় হিজরত করে মহানবী সা. এর নেতৃত্বে সেখানে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের পত্তন করলে মক্কার কাফিরদের মধ্যের বিদ্বেষের অনল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। তারা মুসলমানদের সমূলে নিপাত করার জন্য বাণিজ্যের অজুহাতে সমরাস্ত্র সংগ্রহের জন্য আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে সিরিয়া গমন করে। গাজা থেকে ৫০ হাজার দিনারের মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র ও ধনসামগ্রী নিয়ে প্রত্যাবর্তনকারী আবু সুফিয়ানের কাফেলা মক্কায় গমনকালে রটিয়ে দেয় যে, তারা মদীনার মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তারা মক্কায় দূত পাঠিয়ে সাহায্য কামনা করে এবং মুসলমানদের বাধা দেয়ার জন্য মক্কাবাসীদের আহবান জানায়। আবু সুফিয়ানের ফরিয়াদ মক্কায় পৌঁছতেই কুরাইশরা পুরোপুরি সমর প্রস্তুতি গ্রহণ করে দ্রুত বিপুল বাহিনী নিয়ে মুকাবিলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে এমন কোনো নেতা ছিলনা যে এত শরীক ছিলনা। তারা পাশের সকল গোত্রকেই এতে শরীক করে। এই বাহিনী বিরাট জাঁকজমক, অহঙ্কার, ক্রোধ ও প্রতিশোধমূলক আবেগ-উত্তেজনাসহ রওয়ানা হয়। এতে কুরাইশ নেতা আবু জাহলের নেতৃত্বে সমকালীন প্রসিদ্ধ অস্ত্রশস্ত্র সমেত ১০০০জন প্রথিতযশা সেনা অংশ নেয়।
ঐশীবাণী লাভ :
কুরাইশদের আগমনের সংবাদ পেয়ে মহানবী সা. চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি আল্লাহর দরবারে পরবর্তী করণীয় কী হবে তা সম্পর্কে নির্দেশ লাভের জন্য প্রার্থনায় রত হন। আল্লাহ তা’আলা ওহী নাযিল করে জানিয়ে দেন-“তাদের সাথে যুদ্ধ কর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে সীমালঙ্ঘন কর না। কারণ, সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না। (আল-কুরআন ২:১৯০)। ”অতঃপর মহানবী সা. যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রণাসভার পরামর্শক্রমে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।
কঠিনতম সময়েও বিশ্বনবী সা. এর পরামর্শসভা
রাসূলুল্লাহ সা. যখন জানতে পারলেন, কুরাইশদের এক বিরাট বাহিনী রওয়ানা হয়েছে তখন তিনি সাহাবীদেরকে নিয়ে পরামর্শ করলেন। সে সময় তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আনসারদের দিকে এজন্য যে, তিনি আনসারদের থেকে এ মর্মে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা মদীনায় তাঁকে পূর্ণ হেফাজত ও সাহায্য করবেন। মদীনা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময় তিনি এটা জানতে চান, এই মুহূর্তে আনসাররা কী চিন্তা করছে? সবার আগে মুহাজিররা নিজেদের কথা বললেন এবং খুব ভালভাবে রাসূলুল্লাহ সা. কে সমর্থনের আশ্বাস দিলেন। তিনি আবার পরামর্শ চাইলেন মুহাজিরগণ তাঁকে আবার সমর্থন দিলেন। এরপর তিনি যখন তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, তখন আনসারগণ বুঝতে পারলেন, রাসূলুল্লাহ সা. এর জিজ্ঞাসার লক্ষ্য আনসারদের দিকে।
অতঃপর হযরত সা’দ ইবনু মু’আয রা. তাৎক্ষণিক জবাব দিয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!সা. সম্ভবত আপনার কথার লক্ষ্যবস্তু আমরা এবং আপনি আমাদের কথা শুনতে চাচ্ছেন। ইয়া রাসূলাল্লাহ সা. খুব সম্ভব আপনার ধারণা হচ্ছে, আনসাররা তাদের স্বদেশে ও নিজেদের ভূ-খণ্ডে আপনাকে সাহায্য করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আমি আনসারদের পক্ষ থেকে বিনীত নিবেদন পেশ করছি এবং তাদের পক্ষ থেকে বলছি, আপনি যেখানে খুশি চলুন, যার সঙ্গে ইচ্ছা সম্পর্ক স্থাপন করুন, যার সঙ্গে ইচ্ছা সম্পর্ক ছিন্ন করুন, আমাদের ধন-সম্পদ যত খুশি গ্রহণ করুন এবং যত খুশি আমাদেরকে দান করুন আর তা এজন্য যে, আপনি যা-ই কিছু গ্রহণ করবেন তা আপনি যা বর্জন করবেন তার তুলনায় আমাদের নিকট অনেক বেশি প্রিয় হবে। আপনি যা হুকুম করবেন আমরা তা নত মস্তকে মেনে নেব। আল্লাহর কসম! আপনি যদি চলা শুরু করেন, এমন কি ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্তও পৌঁছে যান তবুও আমরা আপনার সঙ্গে চলতে থাকব। আল্লাহর কসম করে বলছি, আপনি যদি এই সমুদ্রেও প্রবেশ করেন সে ক্ষেত্রে আমরাও আপনার সঙ্গে সমুদ্রেই ঝাঁপিয়ে পড়বো।
হযরত মিকদাদ রা. বলেন, আমরা আপনাকে তেমন কথা বলব না যে কথা মূসা আ. কে তাঁর কওম বলেছিল যে, “ফাযহাব আনতা ওয়া রাব্বুকা ফাক্বাতিলা ইন্না হাহুনা ক্বায়িদূন” অর্থাৎ আপনি ও আপনার রব উভয়ে মিলে যুদ্ধ করুন, আমরা এখানেই বসে থাকব। আল্লাহর কসম, আমরা (আনসাররা) আপনার ডানে লড়াই করব, বামে লড়াই করব, আপনার সামনে থেকে লড়াই করব, আপনার পিছনে থেকে লড়াই করব।
রাসূলুল্লাহ সা. এর চেহারা মোবারক এ কথা শুনে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সাহাবাদের মুখ থেকে উচ্চারিত এসব কথায় তিনি খুবই খুশি হলেন। এরপর তিনি সকলকে লক্ষ্য করে বলেন, “চলো এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর।”
বদর যুদ্ধের ঘটনা :
কুরাইশদের মদীনা আক্রমণের সংবাদ শুনে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা. ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ৩১৩জন সৈন্য নিয়ে কুরাইশদের গতিরোধ করার জন্য মদীনার ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বদর প্রান্তরে উপস্থিত হন। এসময় মুসলীম মুজাহিদদের নিকট কেবল দুটি ঘোড়া ও সত্তরটি উট ছিল। এক একটি উটের পিঠে দু’জন তিনজন করে পালাক্রমে বসে মুজাহিদরা বদর প্রান্তরে সমবেত হন। এদিকে আবু জাহলের নেতৃত্বে ১০০০ সুসজ্জিত কাফের সেনা বদর প্রান্তরে উপস্থিত হয়। আরবীয় রীতি অনুসারে মল্লযুদ্ধে প্রথমে কুরাইশগণের বীর উতবা, শায়বা ও ওয়ালিদ অগ্রসর হলে মহানবী সা. এর নির্দেশে হামজা, আলী আবু ওবায়দা রা. কুরাইশ নেতাদের মল্লযুদ্ধে পরাজিত করেন। উপায়ান্তর না দেখে আবু জাহল মুসলমানদের ওপরে অতর্কিত হামলা চালায়। পরে উভয় বাহিনী সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। আবু জাহলসহ ৭০ জন কুরাইশ যুদ্ধে নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দী হয়। অপরদিকে ১৪ জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। কুরাইশদের মধ্যে যারা যুদ্ধবন্দী হিসেবে মুসলমানদের হাতে নিপতিত হন, মহানবী সা. তাদের প্রতি উদার ও মহানুভব আচরণ করেন। তাদের মধ্যে সামর্থবানদের ৪ হাজার দিরহাম মুক্তিপনের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর যারা মুক্তিপণ দানে অসমর্থ ছিলেন তাদেরকে মুসলমানদের বিরোধিতা না করা এবং মুসলমান বালকদের শিক্ষাদানের শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়।
বদর যুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব :
বদর যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করে অসত্য ও পৌত্তলিকতাকে নির্মূল করার জন্য মুসলমানরা এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অন্যদিকে এই যুদ্ধে মুসলমানরা জয়লাভ না করলে ইসলাম পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে যেত। এ জন্যই বদর যুদ্ধকে মীমাংসার যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে কাফিরদের পরাজিত করে মুসলমানরা প্রথমবারের মত বিশ্বময় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার প্রসারের দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ঐতিহাসিক নিকলসন বলেন,
মিথ্যার ওপর সত্যের জয়: বদর যুদ্ধে বিজয়ী না হলে ইসলাম পৃৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অসত্যের উপর সত্যের, অজ্ঞানতার উপর জ্ঞানের জয় যে অবশ্যম্ভাবী, বদরে তাই প্রমাণিত হয়।
পরবর্তী বিজয়ের ধারা :
বিশাল কুরাইশ বাহিনীর ওপর এ বিজয় মুসলমানদের মনে নতুন আশার সংসার করে পরবর্তী বিজয়ের দ্বার উন্মোচন করে।
কুরাইশদের দম্ভ চূর্ণ :
বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের গগনচুম্বী দম্ভ চূর্ণ এবং ইসলাম আত্মরক্ষায় শঙ্কামুক্ত হয়।
বিশ্বনবী সা. এর ক্ষমতা বৃদ্ধি :
বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে শুধু একটি যুদ্ধ-মাত্রই নয়, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ যুদ্ধ হযরত মুহাম্মাদ সা. এর মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ফলে হযরত মুহাম্মাদ সা. এর বৈষয়িক শক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয়। বদরে মুসলমানরা প্রচুর পরিত্যক্ত সম্পদ প্রাপ্ত হন, যা একটি উদীয়মান সামরিক ও রাষ্ট্র শক্তির জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। বদরের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সাহায্য করে।
বদর যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য..
যুগান্তকারী যুদ্ধ :
এক যুগান্তকারী যুদ্ধ ছিল এ বদর যুদ্ধ। এর পরে যুগ যেন তার গতি পরিবর্তন করল। যে সকল মুসলীম বীর বদর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তারা আরো অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেক দেশও তাদের দ্বারা বিজিত হয়েছে। কিন্তু তারা সেসব জয়-গৌরবকে মূল্য না দিয়ে বদর যুদ্ধে জড়িত থাকার সৌভাগ্য ও গৌরবকেই অধিকতর মূল্যবান মনে করতেন। মক্কা বিজয়ের প্রথম পদক্ষেপ এটাই। এখান থেকেই ইসলামের ইতিহাস নতুন পথে মোড় নিয়েছে। এতদিন ইসলাম ছিল শান্ত। এখন সে দুর্বার গতিশীল। আল্লাহ তা’আলা বদর যুদ্ধকে সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যের দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। সত্যিই এটি সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যের দিন। বিধর্মীদের সকল আশা আকাক্সক্ষা ইতি টেনে তা বিজয় ছিনিয়ে মুসলমানদের ঘরে তুলে দেয়।
মদীনার রক্ষাকবচ :
বদর যুদ্ধকে মদীনা শহরের রক্ষাকবচ বলা হয়। কারণ, বদর যুদ্ধের ওপর ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ভর করছিল। হযরত মুহাম্মাদ সা. যদি এ যুদ্ধে জয়লাভ না করতে পারতেন, তবে কুরাইশরা মদীনা আক্রমন করে নগরীর পৌত্তলিক, ইহুদি-নাসারাদের সাথে নিয়ে বহু বিপদ সৃষ্টি করত। এরূপ বহু বিপদের আশঙ্কা থেকে ইসলাম সেদিন মুক্তি পায়, দুশ্চিন্তার অবসান ঘটে।
নতুন জীবনলাভ :
বদরের বিজয়ে মুসলমানগণ এক নতুন জীবনের সন্ধান পেলেন। তাদের মধ্যে যে অসীম শক্তি ও সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, তারা যে দুর্বার-দুর্দমনীয়, বিপদে যে আল্লাহ তাদের সহায়-এ বিশ্বাস তাদের মনে বদ্ধমূল হয়। তারা বুঝতে পারে, ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র কাঙ্ক্ষিত ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। আর হযরত মুহাম্মাদ সা. সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহর রাসূল। এক নতুন বল, সাহস ও সামরিক প্রেরণায় মুসলমানদের অন্তর ভরে গেল। সত্যের জয় ও মিথ্যার পরাজয়ে সারা প্রকৃতি যেন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তাদের পূর্বেকার মানসিক দোটানা অনেকাংশে তিরোহিত হয়।
বিশ্বজয়ের সূচনা :
বদর যুদ্ধে ইসলামের বিজয় ছিল মূলত বিশ্ব বিজয়ের মূল ভিত্তি। হিট্টির মতে, “এ সশস্ত্র সমরে মুসলমানগণ যে নিয়মানুবর্তিতা ও মৃত্যুর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, এতে ইসলামের পরবর্তী বিজয়ের বিশেষ লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠে। ”বদর যুদ্ধ ইসলামী প্রজাতন্ত্র সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করে। পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে ইসলাম পশ্চিমে আফ্রিকা থেকে পূর্বে মধ্য এশিয়া ও ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
বিশ্বনবী সা. এর ক্ষমতা বৃদ্ধি :
বদর যুদ্ধে বিজয়ের ফলে রাসূল সা. এর ক্ষমতা ও সম্মান বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রাপ্ত হন।
আল্লাহর মদদলাভ: বদর যুদ্ধে মহান আল্লাহ তা’আলা মুসলীম বাহিনীকে গায়েবী মদদ দান করেন। এ যুদ্ধে কয়েক সহস্র ফেরেশতা মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আল্লাহর মদদলাভের ফলে মুসলমানদের ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায়।
ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: বদর যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানগণ এক উদীয়মান সামরিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলে নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়।
অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উপর প্রভাব :
এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে সমগ্র আরবের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী বিশেষত বেদুইন ও ইহুদিদের উপর মুসলমানদের প্রাধান্য অর্জিত হয়। সর্বত্রই ইসলামের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি :
বদর যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়। মুসলমানগণ প্রচুর গনীমত লাভ করে। এতে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়।
রাজনৈতিক বিজয়ের ভিত্তি :
এ যুদ্ধ বিজয়ের ফলে মুসলমানগণ একটি অপ্রতিদ্বন্ধী রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হন। পিকে হিট্টি বলেন, সামরিক ঘটনা হিসেবে যত ছোটই হোক না কেন, বদর যুদ্ধ ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি সুদৃঢ় করে।
মনস্তাত্বিক বিজয় :
বদরের যুদ্ধের বন্দিদের সাথে রাসূল সা. এর মহত্তপূর্ণ উদার আচরণ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে তাদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। এতে ইসলামের নৈতিক ও মনস্তাত্বিক বিজয় সাধিত হয়। এ যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম বিজয়ের যুগে প্রবেশ করে।
সর্বোত্তম ইতিহাস সৃষ্টিকারী যুদ্ধ: ঐতিহাসিক নিকলসন বলেন, দৌড় প্রতিযোগিতায় ম্যারাথন যেমনিভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে, তেমনিভাবে মহানবী সা. এর নেতৃত্বে বদরের যুদ্ধ সর্বকালের জন্য আরব দেশ, ইসলাম তথা পৃথিবীর ভাগ্য নিয়ন্তা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।
ঈমানী শক্তির বিজয় :
এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় ছিল প্রকৃতপক্ষে অনন্য নিয়মানুবর্তিতা, অসামান্য রণনিপুণতা এবং বলিষ্ঠ ঈমানী শক্তির বিজয়।
মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি :
বদরের যুদ্ধে বিজয়ে মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, এ বিজয় বাতিল ধর্ম বিশ্বাসের ওপর মহান আল্লাহর একত্ববাদের বিজয়।
প্রথম সামরিক বিজয় :
বদর যুদ্ধ ইসলামের সোনালি ইতিহাসে সর্বপ্রথম সামরিক বিজয়। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক পি.কে হিট্টি বলেন,“বদর যুদ্ধ ইসলামের প্রথম সামরিক বিজয়। কারণ, এ যুদ্ধ অন্যদের ওপর মুসলমানদের নৈতিক ও সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।”
কুরাইশদের শক্তি খর্ব :
বদর যুদ্ধে কুরাইশদের শক্তি খর্ব ও সর্বপ্রকার অহঙ্কার ধুলিসাৎ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ইসলামের শক্তি গৌরব মদীনার আশেপাশে দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে ইসলাম এতদিন আত্মরক্ষার চিন্তায় শঙ্কিত থাকত; বরং তা এখন পাল্টা হামলা করার শক্তি সঞ্চয় করে।
জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম ও রাষ্ট্রশক্তির একীভূতকরণ :
বদর যুদ্ধে বিজয়ের ফলে জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম ও রাষ্ট্রশক্তি একীভূত হয় এবং হযরত মুহাম্মাদ সা. একাধারে নবী ও রাষ্ট্র পরিচালকের দায়িত্বভার প্রাপ্ত হন।
নবযুগের সূচনা :
মানবতার ইতিহাসে বদর যুদ্ধ এক নবযুগের সূচনা করে। রাসূলুল্লাহ সা. এর উদারতায় মুগ্ধ হয়ে বদরের বন্দীদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি আরো মজবুত হয়।
চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারক যুদ্ধ :
বদর যুদ্ধে স্বল্প সংখ্যক মুসলীম সেনার জয়লাভ একটি চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারক ঘটনা। এ যুদ্ধে পরাজিত হলে হয়ত ইসলাম ও মুসলমানগণ পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে যেত। বিস্মৃতির অতলগর্ভে নিমজ্জিত হতো তাদের ইতিহাস।
জিহাদের অনুপ্রেরণা :
প্রায় এক সহস্র কুরাইশ বীর সেনার বিরুদ্ধে মাত্র তিনশ তের জন মুসলমানের যুদ্ধাভিযান যে অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংঘর্ষ, তা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয়। এ যুদ্ধে জয়লাভ না করলে ইসলাম শুধু রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে নয়; বরং আদর্শ জীবনব্যবস্থা হিসেবেও ধরণীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যেত। বদর যুদ্ধ মুসলমানদের মনে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদের অনুপ্রেরণা সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
মুসলমানরা অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ: ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি বলেন, “বদর যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। এ অগ্নিপরীক্ষায় মুসলমানরা সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হন।”
বীরত্বের মর্যাদা লাভ :
বদর যুদ্ধে হযরত মুহাম্মাদ সা. এর শক্তি সম্মান যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি তাঁর তিনশ তেরজন সাহাবী অবিস্মরণীয় বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁরা দুনিয়ার ইতিহাসে সম্মানজনক ‘বদরী সাহাবী’ খেতাব লাভ করেন।
পার্থিব শক্তির ভিত্তি স্থাপন :
বদর যুদ্ধ জয়ের ফলে হযরত মুহাম্মাদ সা. এর পার্থিব শক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয়। ইসলাম একটি রাষ্ট্রীয় জীবনব্যবস্থায় পরিণত হয় এবং মহানবী সা. আধ্যাত্মিক ও পার্থিব নেতৃত্বের স্বীকৃতি লাভ করেন।
জিহাদ :
জিহাদ মুমিনের জীবন, জীবনের প্রতিশ্রুতি। জিহাদে জীবিত অবস্থায় গাজি মৃত্যুতে শহীদ হওয়ার প্রেরণা এবং পারলৌকিক পুরস্কার লাভের বাসনা তাদের পরবর্তী বিজয়কে প্রভাবান্বিত করে। এভাবে জিহাদ মানুষের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ইসলামের দাওয়াত :
বদর যুদ্ধে বিজয় ছিল ইসলামের অন্যতম এক মহা দাওয়াত। বদরের বিজয়ে সকলের দৃষ্টি ইসলামের ওপর পড়ে। এর পর আরবগণ ইসলামকে যতই উপেক্ষা করুক না কেন, তাকে সম্মান না করে পারে নি। মুনাফিকরা ইসলাম দ্রোহিতার পাপাচার থেকে ক্ষণিকের জন্য নিবৃত্ত হয়। বিধর্মীরাও হযরত মুহাম্মাদ সা. এর আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় আকৃষ্ট হয়। এমনকি রাসূল সা. কে কটাক্ষ করে কবিতা রচনাকারী আসমা বিনতে মারওয়ান এবং আবু আফগানকে স্বগোত্রের লোকেরা বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের পর হত্যা করে। যোশেফ হেল বলেন, “ বিধর্মী আরবদের অধিকাংশ স্বতস্ফূর্তভাবে ইসলামের সুশীতল বারি পান করে। আরব অনারব এমনকি সারা বিশ্বে এ বিজয় ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে।”
বদরের যুদ্ধ ইসলামকে মদীনা প্রজাতন্ত্রের গণ্ডি থেকে বের করে একটি সুসংবদ্ধ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উন্নীত করেছে, শুধু তাই নয়; বরং মদীনাকেও একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজধানীতে পরিণত করে। মহানবী সা. বিজয়ীবেশে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে পরাক্রমশালী যোদ্ধা, সুদক্ষ সমরনায়ক ও সুবিবেচক শাসকের পূর্ণ মর্যাদা লাভ করেন। হযরত মুহাম্মাদ সা. যে কেবল আধ্যাত্মিক পথনির্দেশকই নন, পার্থিব ঘটনাবলির বিচারেও যে তিনি একজন যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতা, বদর যুদ্ধে তা প্রমাণিত হয়। এ বিজয়ে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে।
প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার ও আচার-অনুষ্ঠান পালন, রাষ্ট্রীয় কার্য তত্ত্বাবধান, যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিচালনা এবং দূত প্রেরণ দ্বারা বহির্বিশ্বে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয় এবং বিধর্মীদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে।
বিশ্বজয়ের পথ প্রদর্শক :
ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি বলেন, “এই সম্মুখ যুদ্ধে নিয়মানুবর্তিতা এবং মৃত্যুর প্রতি উপেক্ষার যে দৃষ্টান্ত মুসলমানরা প্রদর্শন করল তাতেই ইসলামের পরবর্তী বিজয়ের বিশেষ লক্ষণসমূহ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে। ” তাই বদরের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে হযরত মুহাম্মাদ সা. ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে খন্দকের যুদ্ধ, ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে হুদায়বিয়ার সন্ধি, ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে মূতার যুদ্ধ, ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয় ও হুনায়নের যুদ্ধ এবং ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে তাবুক অভিযানে সাফল্য লাভ করেন। এ যুদ্ধে জয়েলাভ করায় মুসলমানগণের জন্য পরবর্তী বিশ্বজয়ের পথ উন্মুক্ত হয়। বদরের যুদ্ধের জয়ের সূত্র ধরেই মুসলমানরা পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে পশ্চিমে আফ্রিকা মহাদেশ, ইউরোপের কিয়দাংশসহ পূর্বে ভারতবর্ষ পর্যন্ত নিজেদের সাম্রাজ্যভুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিল।
স্যোসাল লিংকসমূহ