এক.
মার্চ মাস। আমাদের চেতনা জাগানিয়া মাস। জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস জোগানোর মাস। আমাদের স্বাধীনতার মাস। স্বাধীনতা একটি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। স্বাধীনতা সব জাতির পরম আকাঙ্খা। স্বাধীনতা ছাড়া কেউ আত্মমর্যাদাশীল হতে পারে না। স্বাধীনতা ছাড়া জাতিসত্ত্বার বিকাশ হয় না।

স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল একটি শোষণ বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছিল, তা ছিল- “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা”। এই মূলনীতিকে সামনে রেখেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এই আদর্শগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বত:স্ফূর্ত ও বাস্তবসম্মত চেতনা।

বিগত ৪৬ বছরে এদেশের শাসক শ্রেণি কি কখনও মহান মুক্তিযুদ্ধের এসব আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে? স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৪৬ বছরে যারাই দেশ শাসন করেছে সকলেই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করেছে। আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতাকে হরণ করেছে। নির্বাচনে জনগণের রায়কে মেনে না নেয়ার প্রেক্ষাপটে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যার শুভ পরিণতিতে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, অথচ সে স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র যেখানে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাইতো বলতে হয় স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও পরাজিত স্বাধীনতা।

এ অবস্থার পরিবর্তনে নতুন একটি দেশপ্রেমিক আদর্শিক শক্তিকে জেগে উঠতে হবে। প্রতারণা লুটপাট আর বে-ইনসাফির বৃত্ত ভাঙতে হবে। স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। গত ৪৬ বছরে যারা জনগণের স্বাধীনতার স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

দুই.
দু’টি বিষয় বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। একটি ইসলাম অন্যটি মুক্তিযুদ্ধ। ইসলামের প্রভাব বলয় গড়ে উঠেছে হাজার বছর ধরে। বৃটিশ খেদাও আন্দোলন, ৪৭-এর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ- স্বাধীনতার প্রতিটি পর্যায়ে ইসলাম চেতনা জাগানিয়া ভূমিকা পালন করেছে। জনগণের স্বাধীনতার চেতনা ইসলাম থেকেই উৎসারিত হয়েছে।

ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ এ দু’টি হচ্ছে এ জাতির ঐক্যের মূলসূত্র। উন্নতি-অগ্রগতির সোপান। কিন্তু আজ ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে শেখানো হচ্ছে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল ধর্মীয় শক্তির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শক্তির লড়াই। আর এ লড়াইয়ে ধর্মীয় শক্তির পরাজয় ঘটেছে। অথচ পাকিস্তানীদের সঙ্গে আমাদের কোন আদর্শিক লড়াই ছিল না। ছিল অধিকার আদায়ের লড়াই। ভাষার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চাকরি-ব্যবসায় সমতার অধিকার। একাত্তরে আমাদের সংগ্রাম ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য; ইসলাম থেকে নয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে কারণে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসেছি সেখানে ইসলাম প্রশ্নটি কোনভাবেই জড়িত ছিল না। এ জন্যই ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে গর্বের সাথে বলেছিলেন- “আমি একজন মুসলমান। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ।”
অতএব ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাতির মাঝে বিভাজন তৈরি না করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হবে।

তিন.
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭ এপ্রিল ভারত সফরে যাচ্ছেন। আসন্ন সফরে বাংলাদেশ-ভারত “প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্মারক” স্বাক্ষরের কথা ইতোমধ্যে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি। সমঝোতা স্মারকের উল্লেখযোগ্য দিকের মধ্যে রয়েছে ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, যৌথ টহল, অভিযান, প্রশিক্ষণ ও তথ্য বিনিময় ইত্যাদি। স্বাধীনতার এ মাসে ভারতের সাথে এ ধরণের সমঝোতা সংবাদে আমরা আতংকিত। প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণমূলক চুক্তি করার মানসিকতা আমরা বরাবরই লক্ষ্য করেছি।

স্বাধীনতার পরই ১৯৭২ সালে ভারত আমাদের ওপর ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে সে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। দেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট বিবেচনায় আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও সে চুক্তি নবায়ন করে নি। এত বছর পর ভারতের সঙ্গে এ ধরণের একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্বাক্ষরের কেন প্রয়োজন তা আমাদের বোধগম্য নয়। কিছু দিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আসার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তবিত প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক সেরকম কোন মুচলেকা কিনা তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।

আমরা ভারতকে শুধু দিয়েই চলেছি। স্থলভূমি ও বন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছি। নামমাত্র মাশুলে ট্রানজিট দিয়েছি। অসম বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছি। বিনিময়ে আমরা ভারত থেকে ফেলানীর লাশ পেয়েছি। আমরা সরকারকে বলতে চাই, আমরা ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র নয়, তিস্তার পানি চাই। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা চাই। ভারত আমাদের প্রতিবেশী; প্রভু নয়। আমরা পি-ির দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গেছি দিল্লির দাসত্ব বরণ করার জন্য নয়। ভারতের বাংলাদেশ নীতি অনেকটা সিকিমের ধারায় পরিচালিত হয়। প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিকিমের ভাগ্য বরণ করবে। তবে মনে রাখা চাই, এদেশের বীর জনতা তা হতে দেবে না। যে জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সে জাতি স্বাধীনতা রক্ষাও করতে পারবে। এ জাতি কারো বশ্যতা স্বীকার করে নি; করবেও না। স্বাধীনতার মাসে এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।