সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে লাখ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী তুরস্ক, লেবানন ও জর্ডানে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলো হঠাৎ করেই শরণার্থীবিরোধী নানা রকম বিধি-নিষেধ কঠোর করার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে। আর এ কারণেই সিরীয় শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় নেয়ার জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যেই জটিল ভিসা প্রক্রিয়া শুরু কিংবা জোর করে আশ্রয়প্রার্থীদের বের করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। লেবাননে সিরীয় শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এতে মানবাধিকার সংস্থাটি আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায়, লেবাননের নতুন কড়াকড়ির কারণে ওই অঞ্চলে শরণার্থী পরিস্থিতির বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। প্রায় ১০ লাখ সিরীয় বেসামরিক নাগরিককে আশ্রয় দিলেও বর্তমানে নীতিতে পরিবর্তন আনছে লেবানন। চলতি পরিস্থিতিতে উপায়ন্তর না থাকলেও অনেক মানুষই সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে মানবেতর জীবনে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে যারা লুকিয়ে অবৈধভাবে রয়ে যাচ্ছেন, তারা বিভিন্ন সুযোগ সন্ধানীর শিকারে পরিণত হচ্ছেন। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল লেবাননের নতুন নীতিমালার সমালোচনা করে বলেছে, লেবানন তার আন্তর্জাতিক দায়িত্ব ভঙ্গ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহে বৈরুত বিমানবন্দর থেকে ৪০৭ শরণার্থীকে ফিরিয়ে দিয়েছে দেশটি। অথচ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর সিরীয়দের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল লেবানন। সিরীয়রা ইচ্ছা করলেই দেশটিতে আশ্রয় নিতে পারত। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে নীতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বর্তমানে প্রতি ছয় মাস অবস্থানের লাইসেন্সের জন্য প্রতি সিরীয় প্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থীকে ২০০ ডলার দিতে হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর নাদিম হাওরি বলেন, নতুন নীতিমালার কারণে সম্প্রতি বেশিরভাগ শরণার্থীই তাদের অবস্থানের বৈধতা হারিয়েছেন। আর আপনি কোনো দেশে বৈধভাবে অবস্থানের সুযোগ হারালে পদে পদে বাধার শিকার হবেন। আপনি কোনো চেকপয়েন্ট পার হতে পারবেন না। আপনাকে অনেকটা গৃহবন্দি হয়েই থাকতে হবে। কোনো নারী যদি কখনো যৌন নির্যাতনের শিকারও হন, তাহলেও তিনি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারস্থ হতে পারবেন না। কারণ, তাকে দেখামাত্রই গ্রেপ্তার করা হবে। হাওরি আরো বলেন, এই পরিস্থিতিতে পরিবারগুলো শিশুদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, শিশুদের সাধারণত চেকপয়েন্টে থামানো হয় না। জর্ডান পরিস্থিতিও একই রকম। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে সিরিয়া সীমান্তে শরণার্থীদের ভিড় বাড়ার পর সেখানে নতুন বিধিনিষেধ চালু করা হয়। এর আওতায় দিনে মাত্র ৫০ থেকে ১০০ জন মানুষ প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে এই তথ্য জানান জর্ডান সরকারের মুখপাত্র মোহাম্মাদ মোমানি। বর্তমানে প্রায় ১৬ হাজার শরণার্থী সীমান্তে আটকা পড়েছে। জর্ডানে প্রবেশের সুযোগে অগ্রাধিকার পাচ্ছে শিশু, নারী, বয়স্ক ও রোগীরা। মোমানি জানান, বর্তমানে নিরাপত্তাই আমাদের অগ্রাধিকার।
লেবাননে বৈধভাবে থাকতে হলে সিরীয়দের সামনে সাধারণত দুটি উপায় খোলা থাকে। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে জাতিসংঘের শিবিরে নিবন্ধিত হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করা। অপরটি হচ্ছে, লেবাননের কোনো নাগরিকের কাছ থেকে স্পন্সরশিপ নেয়া। তবে স্পন্সরশিপ জোগাড় করতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন আশ্রয়প্রার্থীরা। অনেক সময়ই তারা সুযোগ সন্ধানী কিছু অসাধু লেবানীজের খপ্পরে পড়ছেন। অন্যদিকে, জাতিসংঘের নিবন্ধন প্রক্রিয়া তুলনামূলক কঠিন হওয়ায় স্থানীয়দেরই শরণাপন্ন হচ্ছেন সিরীয় শরণার্থীরা। এদিকে, বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই। অনেকে আবার চরম দারিদ্র্য ও ঋণের জালে এখন জর্জরিত। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, লেবাননে আশ্রয় নেয়া ৭০ শতাংশ সিরীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। অন্যদিকে, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও প্রভাব ছড়াচ্ছে শরণার্থী ইস্যু। জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বাস্তুচ্যুত। সামান্য নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে।
বর্তমানে তুরস্কে প্রায় ২০ লাখ শরণার্থী রয়েছে। তবে তুরস্ক ব্যবহার করে ইউরোপগামী শরণার্থী ঢল থামাতে তারাও ভিসা প্রক্রিয়ায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে। সিরিয়ার রাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে দারোয়ান হিসেবে নিযুক্ত ৩৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন, সিরীয়রা এখন মূল্যহীন। আমাদের জন্য কোনো দরজাই আর খোলা নেই। নিরাপত্তার স্বার্থে নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন ওই ব্যক্তি।
স্যোসাল লিংকসমূহ