quran

মুমিনদের কয়েকটি আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য

“মুমিন তো তারাই, যাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা করে। যারা নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, (তা থেকে) আল্লাহর পথে ব্যয় করে। এরাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে উচ্চমর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক।” -আনফাল : ০২-০৪

সুরা আনফালের এই তিনটি আয়াতে মুমিনদের কয়েকটি আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে।

* প্রথম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হয়েছে- ‘যাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়’। অর্থাৎ তাদের অন্তর আল্লাহর বড়ত্ব এবং ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে যখনই তাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তারা ভীত হয়, তাদের অন্তর আঁতকে উঠে। এই আয়াতটি কুরআনের অন্য একটি আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হয়। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন- ‘আল্লাহর জিকিরের দ্বারাই আত্মা প্রশান্ত হয়।’ আর এখানে বলেছেন- আল্লাহর স্মরণে আত্মা কেঁপে উঠে। বাহ্যিকভাবে আয়াতদ্বয়ের মাঝে বিরোধ দেখা গেলেও মূলতঃ কোন বিরোধ নেই। এই আয়াতে যে ভয় এবং ভীতির কথা বলা হয়েছে, তা মনের প্রশান্তি এবং স্বস্তির পরিপন্থী নয়। আরবিতে ভয় বুঝানোর জন্য দুটি শব্দ ব্যবহার হয়। একটি “খাওফুন” অপরটি “ওয়াজিলুন”। খাওফুন সাধারণ ভয়কে বলা হয়। যেমন- হিংস্র জীবজন্তু বা শত্রুর ভয়। এটি মনের প্রশান্তি দূর করে দেয়। আর ‘ওয়াজিলুন’ বলা হয় যা বড়ত্ব এবং মহত্ত্বের কারণে মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়। কুরআনুল কারীমের এই আয়াতে ওয়াজিলুন শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে।

* আলোচ্য আয়াতে মুুমিনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তার সামনে যখন আল্লাহ তা‘আলার আয়াত পাঠ করা হয়, তখন ঈমান বৃদ্ধি পায়’। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে ঈমানের অর্থ হল অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল- এই তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম। যেহেতু উক্ত বিষয়সমূহের সমষ্টির নাম ঈমান সে হিসেবে এর প্রত্যেকটি দ্বারাই তা বাড়বে এবং কমবে এটিই স্বাভাবিক। অন্তরের বিশ্বাস এবং তার স্থীরতা ও প্রশান্তির দিক থেকে ঈমান বৃদ্ধি পায়। মানুষ তার অন্তরে তা সহজেই অনুভব করে থাকে। যেমন- যখন কোথাও কোন মজলিসে জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা শুনে, তখন তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। মনে হয় যেন জান্নাত- জাহান্নাম স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু যখন মজলিস থেকে উঠে যায়, তখন এই বিশ্বাস কমতে থাকে। এমনিভাবে মুখের আমলের কারণেও ঈমান বৃদ্ধি পায়। কেননা যে ব্যক্তি দশবার আল্লাহর যিকির করল, সে একশতবার যিকিরকারীর সমান নয়। দ্বিতীয় ব্যক্তির আমল প্রথম ব্যক্তির আমলের চেয়ে অনেক বেশি। তাই তার ঈমান বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। অনুরূপ যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে ইবাদত সম্পন্ন করবে আর যে ব্যক্তি ত্রুটিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করবে- উভয়ে সমান নয়। আমলের মাধ্যমেও ঈমান বাড়ে। যে ব্যক্তি বেশি আমল করে তার ঈমান কম আমলকারীর চেয়ে বেশি।

* মুমিনের তৃতীয়গুণ বলা হয়েছে- ‘তারা তাদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা করে।’ তাওয়াক্কুল আরবি শব্দ। শাব্দিক অর্থ ভরসা করা, আস্থা রাখা, নির্ভর করা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় মানবজীবনের যাবতীয় সমস্যা তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তা‘আলার ওপর পরিপূর্ণরূপে ভরসা করাকেই তাওয়াক্কুল বলে। একজন ঈমানদারের জন্য তাওয়াক্কুল একটি আবশ্যকীয় গুণ। তাওয়াক্কুল ব্যতীত ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। অন্য একটি
আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।” -সূরা তালাক : ৩।
আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করা ঈমানের একটি শর্ত। এ মর্মে পবিত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা তাওয়াক্কুল কর, যদি তোমরা মুমিন হও।’ -সূরা মায়িদা : ২৩।
তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসা করার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। তাওয়াক্কুল প্রধানত দুই প্রকার- প্রথমত, তাওয়াক্কুল বেলাআসবাব (উপকরণ ব্যতীত), দ্বিতীয়ত, তাওয়াক্কুল মা‘আল আসবাব (উপকরণসহ)। প্রথম প্রকার তাওয়াক্কুল ব্যাপক নয়, এটি নির্দিষ্ট। অর্থাৎ এ ধরনের তাওয়াক্কুল আম্বিয়ায়ে কেরামদের গুণ। কোনো প্রকার আসবাবপত্র ছাড়াই তারা তাওয়াক্কুল করতে পারেন, আল্লাহ তা‘আলাই তাদের সেই ক্ষমতা দিয়েছেন। দ্বিতীয় প্রকার তাওয়াক্কুল ব্যাপক। এ প্রকার তাওয়াক্কুল সাধারণ মানুষদের জন্য। অর্থাৎ আমাদের চেষ্টা সহকারে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। এভাবে বলা যেতে পারে, গাছ রোপণ করার পর বলতে হবে, তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ। তাওয়াক্কুলের পরিমাণ যার মধ্যে যত বেশি হবে, জীবন চলার পথ তার জন্য তত সহজ ও মসৃণ হবে।

* আলোচ্য আয়াতে ঈমানদারের চতুর্থ গুণ- ‘যারা নামাজ কায়েম করে।’ ইকামাত বা প্রতিষ্ঠা অর্থ শুধু নামাজ আদায় করা নয়; বরং নামাজকে সকল দিক দিয়ে ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হয়। ইকামাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- কোন কিছুকে সোজা দাঁড় করানো, যাতে কোন একদিকে ঝুঁকে না থাকে। তাই ইকামাতে সালাতের মর্মার্থ হল- নামাজের সকল ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা এবং এর ওপর সুদৃঢ় থাকা। রাসুলুল্লাহ সা. যেভাবে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য রীতিনীতি পালন সহকারে নামাজ আদায় করেছেন এবং সারা জীবন মৌখিক শিক্ষাও দান করেছেন, ঠিক সেভাবে নামাজ আদায় করা। অর্থাৎ শরীর, পরিধানবস্ত্র, নামাজের স্থান পবিত্র হওয়া, নিয়মিত জামা‘আতে নামাজ পড়া এবং নামাজের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম সুন্নাত অনুযায়ী সম্পাদন করা। এগুলো প্রকাশ্য রীতিনীতি। অপ্রকাশ্য রীতিনীতি এই যে, আল্লাহর সামনে এমনভাবে বিনয়াবনত ও একাগ্রতা সহকারে দাঁড়ানো যেন তাঁর কাছে আবেদন-নিবেদন করা হচ্ছে। যে ব্যক্তি এভাবে নামাজ কায়েম করে, সে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনা-আপনি সৎকর্মের এবং যাবতীয় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক প্রাপ্ত হয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজ পড়া সত্ত্বেও গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে না, বুঝতে হবে যে, তার নামাজের মধ্যেই ক্রটি বিদ্যমান। ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল প্রভৃতি সকল নামাজের জন্যই এই শর্ত।

* ঈমানদারদের পঞ্চম গুণ হিসেবে বলা হচ্ছে- ‘তাদেরকে আমি যে রিজিক দিয়েছি, তা হতে তারা ব্যয় করে।’ আলোচ্য আয়াতে “রাজাকনা হুম” এই বাক্যটির প্রতি একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি লক্ষ্য করলে তার অবশ্যই বুঝে আসবে যে- আমাদের কাছে যা কিছু অর্থ-সম্পদ রয়েছে, তা সবই আল্লাহর দান ও আমানত। যদি আমরা সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁর পথে ব্যয় করি, তবেই মাত্র এই নিয়ামতের হক আদায় হবে। তখনো এটা আমাদের পক্ষ থেকে কোন ইহসান হবে না। তবে আয়াতে “মিম্মা” শব্দ যোগ করে একথা বুঝানো হয়েছে যে- যে ধন-সম্পদ আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, তা সবই ব্যয় করতে হবে এমন নয়; বরং কিয়দংশ ব্যয় করার কথাই বলা হয়েছে।

আল্লাহর পথে ব্যয় করার ৭ টি ক্ষেত্র রয়েছে। যথা-
১. যাকাত
২. সদকায়ে ফিতর
৩. সাধারণ দান। যেমন- ফকির মিসকিনদের দান করা, মেহমানদারী করা, অভাবগ্রস্তদের অভাব পূর্ণ করা ইত্যাদি
৪. ওয়াকফ। যেমন- মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, জনসাধারণের জন্য পানির ব্যবস্থা, রাস্তা তৈরি ইত্যাদি
৫. হজের কাজে ব্যয়
৬. জিহাদ এবং ইসলামী আন্দোলনের জন্য ব্যয়
৭. পরিবার ও নিকটাত্মীয়ের ভরণ-পোষণ বাবদ ব্যয়।

উপর্যুক্ত আয়াতগুলোতে সত্যিকার মুমিনের কয়েকটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার পর তাদের জন্য ৩ টি বিষয়ে ওয়াদা করা হয়েছে। যথা-
১. সুউচ্চ মর্যাদা
২. মাগফিরাত বা ক্ষমা
৩. সম্মানজনক রিযিক

পূর্ববর্তী আয়াতে মুমিনদের যে গুণ-বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে সেগুলো ৩ প্রকার। যথা-
১. এমন বৈশিষ্ট্য যার সম্পর্ক অন্তর ও অভ্যন্তরের সাথে। যেমন- ঈমান, আল্লাহভীতি, আল্লাহর ওপর ভরসা। এই আত্মিকগুণাবলীর পুরস্কার স্বরূপ নির্ধারণ করা হয়েছে “সুউচ্চ মর্যাদা”।
২. এমন বৈশিষ্ট্য- যার সম্পর্ক দৈহিক কার্যকলাপের সাথে। যেমন- নামাজ, রোজা ইত্যাদি। এর পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছে “মাগফিরাত বা ক্ষমা”।
৩. সেসব বৈশিষ্ট্য যার সম্পর্ক ধন-সম্পদের সাথে। যেমন- আল্লাহর পথে ব্যয় করা। এর জন্য পুরস্কার নির্ধারণ করা হয়েছে- “সম্মানজনক রিযিক”।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মুমিনদের গুণগুলো অর্জন করে পুরস্কার প্রাপ্তির তাওফিক দান করুন। আমিন।
(চলবে)

লেখক-
সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন