বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস
[৬১০ খ্রিস্টাব্দ – ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ]
শেখ মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

হিজরী ১ম শতকেই আরব বণিকদের মাধ্যমে এদেশে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। বাণিজ্যের পাশাপাশি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে তারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন। যার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। চীনের ক্যান্টন সমুদ্রতীরে অবস্থিত সাহাবী আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের রা. মাজার সে সাক্ষ্যই বহন করে। তিনি নবুওয়তের সপ্তম বর্ষে (অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৬১৭ সনে) কাসেম ইবনে হুযাইফা রা., উরওয়াহ ইবনে আছাছা রা. ও আবু কায়েস ইবনুল হারিস রা.সহ চীনের পথে পাড়ি দেন। সমুদ্রতীরে কোয়াংটা মসজিদ তিনিই নির্মাণ করেন। চীন যাবার পথে তাঁকে বাংলাদেশের বন্দরগুলোতেও নোঙ্গর করতে হয়েছে। আর তার পবিত্র সাহচর্যে এসে এদেশের কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সম্প্রতি লালমনিরহাটের সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের মজদের আড়া গ্রামে ৬৯ হিজরীতে বা ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬”ী ৬”ী২ ” সাইজের একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। যার মধ্যে স্পষ্টাক্ষরে আরবীতে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ হিজরী ৬৯” লেখা ছিল। ৬৯ হিজরী ছিল বনু উমাইয়ার যুগ, রাসূল সা. এর যুগের সাথে এর ব্যবধান মাত্র ৫০ বছরের। মসজিদটি ৬৯ হিজরীতে নির্মিত হলেও এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ছিলো আরও আগেই। কারণ সে সময় পাকা ঘর তৈরী করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হতো।
ইসলাম প্রচারের এ ধারা আব্বাসী খেলাফতকালে আরও জোরদার হয়। রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধবিহার খননকালে দু’টি আরবী মুদ্রা পাওয়া যায়। এই মুদ্রা দুটি তৈরী হয়েছিল ৭৮৮ খৃস্টাব্দে অর্থাৎ আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশীদের আমলে। ইতিহাসবিদ ড.এনামুল হকের মতে, কোন ইসলাম প্রচারক এই মুদ্রাগুলো বহন করেছিলেন। পাহাড়পুরে আসারপর বৌদ্ধদের হাতে তিনি শহীদ হন।
কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে খননকালে আব্বাসী যুগের আরও দু’টি ¯^র্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। এসব মুদ্রাপ্রাপ্তি এ কথাই প্রমাণ করে, খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে এদেশে আরব মুসলমানদের যাতায়াত ছিল। খ্রিস্টীয় দশম শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি মুসলিম রাজ্য স্থাপিত হয় বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। মূলত; হিজরী প্রথম শতকেই বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটে ছিল। যারা ঐ সময় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে এতদঞ্চলে আগমন করেন তাঁদের পরিচয় সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। পরবর্তী কালে আগতদের মাত্র কয়েকজনের নাম জানা যায়।

১০০০ খ্রি. ১২০০ খ্রি.

মধ্য এশিয়ার বলখের শাসক শাহ মুহাম্মাদ সুলতান বলখী রহ. রাজ্যশাসন ত্যাগ করে দামেশক এসে তাওফীক নামক এক বুযুর্গের সংশ্রবে থাকেন বহু দিন। ঐ বুযুর্গ তাঁকে বাংলায় এসে ইসলাম প্রচারে উৎসাহিত করেন। শাহ মুহাম্মাদ সুলতান বলখী রহ. ১০৪৭ঈ. মোতাবেক ৪৪০হি. সনে নৌপথে স›দ্বীপ পৌঁছেন। সেখান থেকে তিনি হিন্দু রাজা বলরামের রাজ্য হরিরামনগরে আসেন। সেখানে তিনি ইসলাম প্রচার শুরু করলে রাজা বলরাম বাধা দেন। ফলে উভয়ের মাঝে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে রাজা নিহত হন। রাজার মন্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করলে শাহ বলখী রহ. তাকেই সিংহাসনে বসান। অত:পর তিনি রাজা পশুরামের রাজ্য বগুড়ার মহাস্থানগড়ে আসেন। রাজা পশুরাম সুলতান বলখী ও তার সঙ্গীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান। যুদ্ধে রাজা নিহত হন। মহাস্থানগড়ে শাহ মুহাম্মাদ সুলতান বলখী মসজিদ ও ইসলামী শিক্ষালয় স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন।
১০৫৩ মোতাবেক হিজরী ৪৪৬ হিজরী সনে শাহ মুহাম্মাদ সুলতান রুমী রহ. প্রথমে চট্টগ্রামে আগমন করেন। অত:পর মেঘনা ও ব্র²পুত্র হয়ে বর্তমান নেত্রকোণার মদনপুরে কোচ রাজার রাজ্যে ইসলাম প্রচার করেন।
খ্রিস্টীয় ১১১৯ সালে বিক্রমপুরে আদম নামক একজন মুবাল্লিগ এসেছিলেন। তখন এটি রাজা বল্লাল সেনের শাসনাধীন ছিল। রাজা বল্লাল সেন ইসলাম প্রচারে বাধা দেন। এতে মুসলমানদের সাথে তার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আদম শহীদ রহ. শাহাদাৎ বরণ করেন। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ দশকের শেষ দিকে শাহ মাখদুম রুপোস নামক একজন দাঈ রাজশাহী অঞ্চলে আসেন। তাঁর দাওয়াতেও বহুলোক ইসলাম গ্রহণ করেন।

১২০০খ্রি. ১৩০০খ্রি.

বঙ্গদেশ মুসলিম শাসনের স্থপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী। তিনি উত্তর আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। ১১৯৩ সালে তিনি ভারতে আসেন। দিল্লীতে তখন কুতুবুদ্দীন আইবেকের শাসন ছিল। ১২০৪ সালে তারই প্রতিনিধি হিসেবে বখতিয়ার খিলজী বিহার ও বাংলা জয় করেন।
১২৭৮ সালে ইসলামের অন্যতম মুবাল্লিগ ও মুহাদ্দিস শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ পূর্ব বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও তাশরীফ আনেন। তিনিই এদেশে প্রথম বোখারী শরীফ নিয়ে আসেন এবং ইলমে হাদিসের মারকায স্থাপন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এটাই হলো উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের প্রথম মাদরাসা। তখন ঐ মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা ছিল দশ হাজার। শায়খ আবু তাওয়ামা রহ. দীর্ঘ ২৩ বছর ইলমে দীনের খেদমত করার পর ১৩০০ সালে ইন্তেকাল করেন এবং সোনারগাঁও এ-সমাধিস্থ হন।

১৩০০খ্রি. ১৪০০খ্রি.

১৩০৩ সালে বিখ্যাত ওলী শাহজালাল ইয়ামানী রহ. রণপ্রস্তুতি নিয়ে সিলেট আগমন করেন। তখন গৌরগোবিন্দ নামক একজন হিন্দু রাজা সিলেট শাসন করত। সে ছিল মুসলিম নির্যাতক। তখন লাখনৌতির শাসক-ছিল সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ। তিনি সেনাপতি সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে। দুইবার হামলা চালিয়েও সিকান্দার গাজী তাকে পরাজিত করতে পারেননি। পরে অন্যতম সেনাপতি সাইয়েদ নাসিরুদ্দীন তাঁকে সহযোগিতা করেন। তদুপরি বিখ্যাত ওলী শাহজালাল রহ. তাঁর তিনশত ষাট জন সাথী নিয়ে মুসলিম বাহিনীতে যোগ দেন। আবারও সামরিক অভিযান পরিচালিত হয় গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে। গৌরগোবিন্দ পরাজিত হয়ে জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যায়। খ্রিস্টীয় ১৩০৩ সনে সিলেট লাখনৌতি রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। সিলেট বিজয়ের পর হযরত শাহজালাল রহ. তাঁর সাথীদের নিয়ে সিলেট অঞ্চলে থেকে যান। তাঁর উন্নত চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে বাংলার হাজার হাজার হিন্দু-বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৩৪১ সালে এ মহান ওলী ইন্তেকাল করেন এবং সিলেটে সমাধিস্থ হন।

১৪০০খ্রি – ১৫০০খ্রি

হযরত খানজাহান আলী রহ. ছিলেন একজন ইসলাম প্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের স্থানীয় শাসক। তিনি ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন। খানজাহান আলী রহ. ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনাবাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্মজীবন আরম্ভ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নিত হন। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি জৈনপুর প্রদেশের গভর্নর পদে যোগ দেন। পরবর্তীতে তাঁর নেতৃত্বে ৬০,০০০ হাজার অগ্রবর্তী সেনাদলসহ আরও দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন। ফলে স্থানীয় শাসক রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেয়। ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে খানজাহান আলী রহ. যশোরের বার বাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম প্রচার করেন। সুলতান নাছির উদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে (১৫৩৪) তিনি বাগেরহাটে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খানজাহান আলী বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল স্থাপন করেন। যা পরে ষাট গ¤^ুজ মসজিদ হয়। হযরত খানজাহান আলী রহ. বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার বিভিন্ন অংশে সর্বপ্রথম মুসলিম বসতি গড়ে তোলে ছিলেন। তিনি এই দুই জেলায় কয়েকটি শহর প্রতিষ্ঠা, মসজিদ, মাদরাসা, সরাইখানা, মহাসড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং বহু সংখ্যক দিঘি খনন করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তি বর্তমান বাগেরহাটের ষাট গ¤^ুজ মসজিদ। হযরত খানজাহান আলী রহ. ২৫ অক্টোবর ১৪৫৯ তারিখে ষাট গ¤^ুজ মসজিদে এশার নামাজরত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

১৫০০খ্রি. – ১৭৫৭ খ্রি.

১৫১৬ খ্রি. আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের শাসনকালে চট্টগ্রাম বাংলা সালতানাতের অধীনে আসে এবং দারুল ইসলামে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে মুঘল-আফগান দ্বন্দে¦র সময় আরাকানের রাজা চট্টগ্রাম দখল করে নেন। তখন থেকে চট্টগ্রাম মগ ও পর্তুগীজদের লুণ্ঠন ভূমিতে পরিণত হয়। খ্রিস্টীয় ১৬৬৬ সনের ২৭ শে জানুয়ারি স¤্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে শায়েস্তা খাঁ’র ছেলে উমেদ খাঁ চট্টগ্রাম বিজয় করেন। চট্টগ্রাম বিজয়ের খবর দিল্লীতে পৌছলে আওরঙ্গজেব এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ। চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মারক হিসেবে স¤্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে এখানে নির্মাণ করেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ।
১২০৩ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ৫৫৪ বছর মুসলিম শাসকগণ এদেশ শাসন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলা-বিহারের ও উড়িষ্যায় নওয়াব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে সুদীর্ঘ ৫৫৪ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং এদেশে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। ইংরেজশাসন এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম বঙ্গদেশ থেকেই শুরু হয়। পলাশীর প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিজয় লাভের পরিণতিতে এই দেশের জনগণকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হতে হয়। ব্রিটিশরা মুসলমানদের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ফলে মুসলমানদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। তাদের সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক শোষণের ফলে মুসলমানদের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। দেশে গোলাম বানানোর উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ১৯০ বছর এদেশের মানুষকে ইংরেজদের গোলামীতে থাকতে হয়।

১৭৫৭খ্রি. ১৮৫৭খ্রি.

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এদেশে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। ১৮০৫ সালে তারা দিল্লি দখল করে ঘোষণা করল- ‘এখন থেকে ভারতবর্ষের শাসননীতি হবে, সৃষ্টি ¯্রষ্টার, স¤্রাজ্য স¤্রাটের, আর কর্তৃত্ব থাকবে কোম্পানীর হাতে।’ তখন শাহ আব্দুল আজিজ রহ. দিল্লির হাদিসের মসনদ থেকে ঘোষণা করলেন, এখন থেকে ভারতবর্ষ দারুল হরব (শত্রæ কবলিত এলাকা)। সুতরাং প্রতিটি ভারতবাসীর কর্তব্য হলো একে ¯^াধীন করা। দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল এই ফতওয়ার ঘোষণা। জ্বলে উঠলো ¯^াধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষের হৃদয়ের বহিৃশিখা। হযরত শাহ আব্দুল আজিজ রহ. এর দারুল হরব ঘোষনায় প্রভাবিত হয়ে হাজী শরীয়ত উল্লাহ বঙ্গদেশকে দারুল হরব ঘোষণা দেন। যেহেতু দারুল হরবে জুমা ও ঈদের নামাজের বিধান নেই, একারণে তিনি এদেশে ঈদ ও জুমার নামাজ বিধি সম্মত নয় বলে ফতওয়া প্রদান করেন। হাজী শরীয়ত উল্লাহ ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বর্তমানে মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৮ বছর বয়সে হজ্ব করতে গিয়ে দীর্ঘ ২০ বছর আরব দেশে অবস্থান করে শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ১৮১৮ সালে দেশে ফিরে ¯^দেশের মানুষের হিদায়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামী আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়ন, নির্যাতিত মানুষের মাঝে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করণ , পরাধীনতার শৃংক্সখল থেকে মুসলমানদের মুক্ত করণই ছিল তাঁর মিশনের মূল উদ্দেশ্য। ইসলামের যে সকল ফরজ বিধান মানুষ ছেড়ে দিয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি অধিক গুরুত্বারোপ করতেন। এজন্য তাঁর আন্দোলন ফরায়েজী আন্দোলন নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাঁর অব্যাহত কর্মতৎপরতার ফলে সারা দেশের মুসলমানদের মাঝে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। ১৮৪০ সালে এই সমাজ সংস্কারক মর্দে মুজাহিদ ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্র মুহসীন উদ্দিন (দুদু মিয়া) এই আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণের পর ফরায়েজী আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার হয়। ইংরেজদের মদদপুষ্ট হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুসলমান কৃষকদের রক্ষা করার জন্য তিনি বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। ১৮৪১ ও ১৮৪২ সালে তিনি কানাইপুর ও ফরিদপুরের জমিদারদের বিরুদ্ধে দুটি যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন।
উপমহাদেশের ¯^াধীনতা সংগ্রামের সিপাহসালার সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রহ.) এর আন্দোলনের বঙ্গদেশীয় অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন শহীদ তিতুমীর (রহ.)। জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও নারিকেল বাড়িয়ায় তাঁর ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ১৭৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলায় শহীদ তিতুমীরের জন্ম হয়। ১৮২২ সালে তিনি মক্কায় হজ্ব করতে যান। সেখানে তিনি ¯^াধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রহ.) এর কাছ থেকে জিহাদী চেতনার দীক্ষা গ্রহন করেন। ১৮২৭ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে জনগনকে ¯^াধীনতার পক্ষে উজ্জীবিত করতে থাকেন। মুসলমানদের ঈমান ও আমলের হিফাজতের জন্য একটি ¯^াধীন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা তিনি তীব্রভাবে অনুভব করেন। দলে দলে লোক তাঁর এই চেতনাকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হয়। একসময় তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ৫০০০ গিয়ে পৌছে। তারা সশ¯্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। ১৮৩১ সালে ২৩ অক্টোবর বারসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় তাঁরা বাশেঁর কেল্লা তৈরী করেন। বাঁশ আর কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এই কেল্লা নির্মাণ করেন। তিতুমীর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার নিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ¯^াধীনতা ঘোষনা করেন এবং একটি ¯^াধীন ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। মিসকীন খাঁকে প্রধানমন্ত্রী ও গোলাম মাসুদ খাঁকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়ে ছিল। স্থানীয় জমিদারদের নিজ¯^ বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। অবশেষে ১৮৩৯ সালের ১৩ নভে¤^র ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর তাঁর বাহিনী সহ একমাত্র অস্ত্র বাশেঁর লাঠি নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ইংরেজদের কামানের গোলায় তাঁর বাঁশের কিল্লা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ১৪ নভে¤^র তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তাঁর বাহিনীর প্রধান গোলাম মাসুদকে ফাঁসি দেওয়া হয়। মহান শহীদ তিতুমীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম করেছেন, কিন্তু আপোষ করেন নি।
বাহাদুর শাহ্ পার্ক : ১৮৫৭ সনের সিপাহ-জনতার মহাসংগ্রামের স্মারক
১৮৫৭ সনে ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী-জনতার যে অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল বাংলাদেশেও তার ঢেউ লেগেছিল। ১৮৫৭ সালের ২২ নভে¤^র লালবাগে সিপাহী-জনতা সম্মিলিতভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য বিপ্লবীকে। তারপর জনগনকে ভয় দেখাতে বিপ্লবীদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয় তৎকালিন ভিক্টোরিয়া পার্কের বিভিন্ন গাছের ডালে। ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে বাহাদুর শাহ্ পার্ক রাখা হয়।

-লেখক
কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন