বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব ও সম্ভাবনা

নিজামুদ্দীন আল গাজী

ইসলামী সংস্কৃতির স্বরূপ
ইসলাম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন দর্শন। আর এই জীবন দর্শনের মূলনীতির ওপর ইসলামী তামাদ্দুন বা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত। ইসলামী সংস্কৃতি কোন জাতীয় বংশীয় বা গোত্রীয় সংস্কৃতি নয়; বরং সঠিক অর্থে এটি হচ্ছে মানবীয় সংস্কৃতি। এর মধ্যে বর্ণ-গোত্র-ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্যই কল্যাণ রয়েছে। ইসলামী সংস্কৃতি এমনই এক সংস্কৃতি যার মধ্যে রয়েছে দুনিয়াব্যাপী সম্প্রসারণের ক্ষমতা। এর কিছু মৌলিক দিক রয়েছে আর কিছু শাখাগত দিক। তাওহীদ, রিসালাত, কিতাব ও আখিরাত এগুলো ইসলামী সংস্কৃতির মৌলিক দিক। যে ব্যক্তি তাওহীদ, রিসালাত, কিতাব ও আখিরাতে বিশ্বাস করে সে নিজেকে ইসলামী সংস্কৃতির গণ্ডির মধ্যে শামিল করে নিল। নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাত হলো তার বুনিয়াদি ইবাদত। আর শাখাগত দিক, নৈতিক কর্মকাণ্ড; যেমন- ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, সহনশীলতা, উপদেশ, পরোপকার, আদল, ইহসান, দয়া, ভালোবাসা, ক্ষমা-উদারতা, দানশীলতা ও বদান্যতা ইত্যাদির গুণাবলী সৃষ্টি। পাপাচার, রাগ, ক্রোধ, লোভ, মোহ ইত্যাদি অপরাধসমূহ বর্জন। অর্থনৈতিক লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয় শ্রমের মজুরি আদান প্রদানও ইসলামী সংস্কৃতির আওতাধীন। সামাজিক ও ব্যবহারিক আচরণ, যেমন পিতা মাতার প্রতি সম্মান, সৌজন্যমূলক ব্যবহার, সুন্দর জীবন, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা ও তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক প্রতিবেশীর অধিকার আদায় ইত্যাদি কার্যকলাপও ইসলামী সংস্কৃতির অন্তর্গত। ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প- সাহিত্য, রীতি-নীতি, জীবন পদ্ধতি ইত্যাদি কোন কিছু চর্চাকেই নিরুৎসাহিত করে না। তবে ইসলামের লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো উল্লিখিত বিষয়গুলো ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে সম্পন্ন হচ্ছে কি না? এর মৌল উপাদান ও ভিত্তিগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কি না? সাংঘর্ষিক না হলে তা গ্রহণ করা যাবে। আর সাংঘর্ষিক হলে তা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

বাংলার সংস্কৃতি
সংস্কৃতি মানুষের জীবনের একটি বিকশিত ও পরিশীলিত রূপ। জীবন ধারার কাঠামো, বিস্তৃতি ও রূপ বৈচিত্রের বাইরে সংস্কৃতি কোনো ভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার বছর থেকে এ ধারাই অব্যাহত আছে। সংস্কৃতি যদি অপরিবর্তনীয় হতো তা হলে গোটা দুনিয়া জুড়ে মানবজাতির সংস্কৃতি হতো এক ও অভিন্ন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্ন সংস্কৃতির বিকাশ দেখা গেছে। এগুলো সবই মানুষের বিভিন্ন জীবনধারা ও জীবন চর্চার ফল। জীবন চিন্তা ও জীবন দর্শনের ভিত্তিতে সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে এবং তা বিভিন্ন রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে কালের পরিক্রমায় ভিন্ন ভিন্ন জাতির আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা তাঁদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ও আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতি।

ইসলামী-জীবন চর্চাই ইসলামী সংস্কৃতি। মুসলমানরা যেভাবে তাদের জীবন গড়ে তোলে ইসলামী সংস্কৃতিও তাদের হাত ধরে ঠিক তেমনি রূপ লাভ করে। বাংলার সংস্কৃতি ইসলামী রূপে রূপায়িত হয়েছে। ইসলামের সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাহলে বলতে হয় বাংলার সংস্কৃতি প্রাচীনকাল থেকে ইসলামী সংস্কৃতিতে সংস্কৃত হয়েছে। এ ভ‚খণ্ডে মুসলমানরাই আদি বাস গড়েছে। কারণ মুসলিম সমাজ ছাড়া ইসলামী-সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারে না। তাই এই জনপদের মানুষ ইসলামপূর্ব প্রাচীনযুগে একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলো এবং ইসলাম আগমনের পর তারা ইসলামকেই নিজেদের অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করেছে, সে বিষয়টিই এই নিবন্ধে প্রমাণ করা হবে ইনশাআল্লাহ। তবে বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে তোলার জন্য প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করা প্রয়োজন। সংগত কারণেই নিবন্ধে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

প্রাচীন বাংলা ভূমি
বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে যে ভ‚-খণ্ড আমাদের মাঝে পরিচিত প্রাচীন যুগে তার শুধু একটি মাত্র নাম ছিলো না, বরং এ সব এলাকার বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে আখ্যায়িত হতো।
১. উত্তরাঞ্চল- বরেন্দ্র (পুন্ড্রবর্ধন ও গৌড় এলাকাকে বলা হতো)।
২. দক্ষিণের নিম্নভূমি অঞ্চল- বঙ্গ। এ নাম থেকেই পরবর্তীকালে সমগ্র ভূ-খণ্ডের নামকরণ করা হয়।
৩. মেঘনার পূর্ববর্তী এলাকা- কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম সমতট নামে পরিচিত ছিলো।
এগুলোকে একত্রে ‘বাংলা’ নামকরণ মাত্র কয়েকশ বছর আগের ঘটনা। মুসলমান শাসনামলেই সর্বপ্রথম এ সমগ্র এলাকাকে বাংলা বা বাঙ্গালা নামে অভিহিত করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক অবধি লিখিত গ্রীক ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী গঙ্গার সর্বপশ্চিম ও সর্বপূর্ব দু’ধারার মধ্যবর্তী ব-দ্বীপ অঞ্চলই আসল বঙ্গ। এর প্রায় সবটুকুই (২৪ পরগণা, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলার অংশবিশেষ ছাড়া) বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত। সম্রাট আকবরের শাসনামলে সমগ্র বাংলাদেশ ‘সুবা-ই-বাঙ্গালাহ্’ নামে পরিচিত হয়।
ফার্সী বাঙ্গালাহ্ থেকে পর্তুগীজ ইবহমধষধ বা ঢ়বহমধষধ এবং ইংরেজি ইবহমধষ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। কেউ বলেছেন বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয়ের লক্ষ্যে আক্রমণের প্রাক্কালে সতীর্থদের বলেন, ‘বাংগ আল্লাহ’ তথা ‘আল্লাহর নামে তাকবির দাও’ সেখান থেকে বাঙ্গলা হয়েছে।

বাংলার অধিবাসী
বাংলার আদি অধিবাসী কারা এ নিয়ে মতভেদের অন্ত নেই। প্রাচীনকালে এদেশের সবটুকু সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থিত না হলেও এখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাই পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বেও এখানে মনুষ্য বসতি ছিলো বলে অনুমান করা হয়। অতি প্রাচীন কালে এখানে আর্যদের আগমনের পূর্বে অন্ততপক্ষে আরো চারটি জাতির নামোল্লেখ করা হয়। এ চারটি জাতি হচ্ছে: ১. নেগ্রিটো, ২. অস্ট্রো-এশিয়াটিক, ৩. দ্রাবিড় ৪. ভোটচীনীয়।
নগ্রিটো; নিগ্রোদের ন্যায় দেহ গঠন যুক্ত এক আদিম জাতির এদেশে বসবাসের কথা অনুমান করা হয়। কালের বিবর্তনে বর্তমানে তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিলুপ্ত। প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে অষ্ট্রো-এশিয়াটিক বা অস্ট্রিক জাতি বাংলায় প্রবেশ করে নেগ্রিটোদের উৎখাত করে বলে ধারণা করা হয়।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)