tazul islam shahin

ইতিহাসের ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন ভূমির প্রাচীন নাম কানআন; কারণ, ঐতিহাসিকভাবে এখানে অবস্থান গেড়েছিল কানআনি সম্প্রদায়। যারা খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার সহস্রাব্দের সূচনাতে আরব উপদ্বীপ হতে এখানে আগমন করেছিল। ফিলিস্তিন নামটি সমুদ্র উপকূলীয় এক সম্প্রদায়ের নাম হতে নেয়া হয়েছে। প্রাচীনকালে কানআন নামে পরিচিত ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ডের আয়তন ছিল ২৫০০ বর্গকিলোমিটার। দেশটি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল এবং মিশর, জর্দান, সিরিয়া ও লেবাননের পাশে অবস্থিত। প্যালেস্টাইন নবীদের পূন্যভূমি। এ ভূমিতে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইয়াকুব, ইউসুফ, লুত, দাউদ, সোলাইমান, সালেহ, জাকারিয়া, ইয়াহইয়া ও ঈসা (আ.) জীবন-যাপন করেছেন, পবিত্র কুরআনে যার উল্লেখ পাওয়া যায়।

ফিলিস্তিনের রাজধানী জেরুজালেমে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ মুসলমানদের ‘প্রথম কেবলা’। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পর ৬২৩ খৃস্টাব্দে বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে মহান আল্লাহ মসজিদুল আকসা থেকে মুসলমানদের ‘কেবলা’ কাবার দিকে করে দেন। এই মসজিদ থেকে হযরত মুহাম্মদ সা. মেরাজে গিয়েছিলেন। এ সকল কারণে জেরুজালেম তথা সমস্ত ফিলিস্তিন মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পবিত্রভূমি। জেরুজালেম শহর শুধু মুসলমানদের কাছেই পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ নয়; ঐতিহাসিক কারণে ইহুদি-খৃস্টানদের কাছেও এই শহরের গুরুত্ব অনেক। হযরত মুসা আ. এবং হযরত ঈসা (আ.)-সহ অসংখ্য নবী ও রাসূল আ. এর পূণ্য-স্মৃতিবিজড়িত এই অঞ্চল। ইসলামপূর্ব সময় থেকেই এ অঞ্চল নিয়ে চলছে তীব্র সংঘর্ষ। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন ‘আন্তর্জাতিক রণক্ষেত্র’ ফিলিস্তিন তথা সমস্ত সিরিয়া সাম্রাজ্য।

কালক্রমে ফিলিস্তিন
৩০৩-৩২৩ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত রোমানদের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের কর্তৃত্ব। তবে এসময় এই অঞ্চলের প্রতি খৃস্টানদের কোন আগ্রহ ছিল না। খৃস্টানদের সহযোগিতায় কনস্টান্টাইন রোমের সম্রাট হন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কনস্টান্টাইন ফিলিস্তিনে অসংখ্য গির্জা তৈরি করে দেন। এতে জেরুজালেমের প্রতি খৃস্টানদের শ্রদ্ধাবোধ জাগে। ৬১৮ বা ৬২০ খৃস্টাব্দে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ এন্টিয়ক, সিজারিয়া, দামেশক দখলে নেন। তারপর জেরুজালেম আক্রমণ করলে রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস যুদ্ধে না পেরে প্রচুর অর্থ করসহ খসরু পারভেজের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেছিলেন। উল্লেখ্য, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে পারস্যের মানুষ ছিল অগ্নিপূজক। ইতিহাস বলে, ১৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পাঁচশো বছর সময় পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাসে কতিপয় ইহুদি বসবাস করতো।

হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর জন্ম ৫৭০ খৃস্টাব্দে। নবুওয়াত লাভ ৬১০ খৃস্টাব্দে। ৬২৮ খৃস্টাব্দে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর তিনি বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এসময় পারস্যসম্রাট পারভেজ হযরত মুহাম্মদ সা. এর চিঠি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেন এবং তাঁর দূতকে অপমান করেন। এখানেই ক্ষান্ত না হয়ে তিনি ইয়ামেনের শাসক বাজানকে নির্দেশ দিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে গ্রেফতারের। কিন্তু গ্রেফতারে প্রেরিত বাহিনী মদিনায় পৌঁছার পূর্বেই পারভেজ তার নিজ বিদ্রোহী ছেলের হাতে বন্দি অবস্থায় প্রাণ হারান। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারভেজের ছেলের কাছ থেকে ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে আবার ফিলিস্তিন ছিনিয়ে নিলেন। ৬৩৭ খৃস্টাব্দে হযরত ওমর রা.-এর শাসনামলে সমস্ত ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ ও শাসকেরা ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত ওমর রা. এই সময় ফিলিস্তিনে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস বলে, ৬৩৭-১০৮৭ খৃস্টাব্দের মালিক শাহের শাসনকাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের সামাজিক ও সামরিক অবস্থা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ছিলো।

মালিক শাহের মৃত্যুর পর একদিকে ক্ষমতা নিয়ে তার ছেলেদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয় অন্যদিকে ১০৯৫ খৃস্টাব্দে খৃস্টান ধর্মগুরু পোপের মনে ফিলিস্তিন দখলের লোভ জাগে। তিনি এই উদ্দেশ্যে পিয়াসেঞ্জারে বৈঠক করেন। সেখানে ফ্রান্স, ইতালি, সুয়েবিয়া, ব্যাভেরিয়া ও বার্গান্ডী থেকে দু’শ বিশপ, চার’শ পাদ্রী, তিনলক্ষ গ্রহী সমবেত হন। কিন্তু ধর্মপ্রাণ কিছু খৃস্টান ধর্মগুরু আপত্তি করায় সেদিন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে তিনি আবার বৈঠক ডাকেন এ বছরই ১৮অক্টোবর, ফ্রান্সের কারমন্টে। সেখানে পোপ নির্বাচনকারী প্রধান পাদ্রী-সপ্তক কার্ডিনাল ছাড়া তেরজন আর্চ বিশপ, দু’শ পঁচিশজন বিশপ, চার’শ কিরীটধারী বিশপ, অসংখ্য লর্ড ও নাইট যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে পোপ নিজে ফিলিস্তিন দখল করার প্রস্তাব দিয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে সরলপ্রাণ খৃস্টানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন। ফলে শতসহস্র খৃস্টান যুদ্ধের জন্যে পোপের কাছ থেকে ক্রুশ গ্রহণ করে। এই যুদ্ধকে খৃস্টান জগৎ ধর্মযুদ্ধ হিসেবে নামকরণ করলো ‘ক্রুসেড’। ১০৯৬-১৫২৯ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ক্রুসেডের মাধ্যমে পশ্চিমা পৃথিবী জেরুজালেম বা ফিলিস্তিন দখলের চেষ্টা করে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে শুধু নবম ও দশম হিজরী শতাব্দীতে ইউরোপীয় সমস্ত রাষ্ট্রের সহযোগিতায় অল্প সময় জেরুজালেম পশ্চিমাদের দখলে ছিলো। ১১৮৭ খৃস্টাব্দে গাজী সালাউদ্দীন আয়ূবীর নেতৃত্বে মাত্র পঁচাত্তর দিনের অভিযানে সম্মিলিত ইউরোপীয় বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তবে ১৫২৯ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ক্রুসেডে ব্যর্থ হয়ে খৃস্টানজগত ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়।

সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমানদের আয়ত্ত্বে আসা ফিলিস্তিন তুর্কি সাম্রাজ্যের শেষ পর্যন্ত তা অক্ষুণ্ন থাকে। অকৃতজ্ঞ যাযাবর জাতি হিসেবে পরিচিত ইহুদিদের প্রতি করুণা দেখিয়ে মাথা গুজার ঠাঁই দিয়েছিল ফিলিস্তিনি মুসলমান। তখন তাদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। আজ যে ইহুদীরা মুসলমানদেরকে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত করার জন্য উত্তপ্ত করে রেখেছে ফিলিস্তিনকে, সে ইহুদিরা মুসলিম শাসনের অধীনে সবসময়ই নিরাপদ থেকেছিলো।

শোয়াহ ইহুদি নিধনের বাস্তব মিথ্যা
পাঠক, এবার চলমান আলোচনা থেকে একটুখানি সরে যাই ধূর্ত ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের ভিতর ষড়যন্ত্রের উদঘাটনের দিকে। ইহুদিরা দাবি করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ হিটলার ইউরোপীয় ইহুদিদের সার্বিকভাবে হত্যা করতে চেয়েছিলো। অর্থাৎ তখন ইহুদিদের ওপর দিয়ে হলোকস্ট বা শোয়াহ (সুপরিকল্পিতভাবে কোনো জাতিকে সার্বিকভাবে হত্যা করা) বয়ে গিয়েছিলো। মোট ষাট লক্ষ ইহুদি মৃত্যুবরণ করেছিলো বলে দাবি করা হয়। অন্তত এরকমই সবাইকে শেখানো হচ্ছে গত সত্তর বছর ধরে। এ হলোকস্টের মধ্যে রয়ে গেছে অনেক চালাকি আর ষড়যন্ত্র।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানাগুলোতে হঠাৎ হরতাল শুরু হয়ে যায়, ফলে জার্মানি যুদ্ধে হেরে যায়। এ হরতালের পেছনে ইহুদিদেরই হাত ছিল। এ রাগে হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করেছিলেন এবং সবাইকে বন্দিশিবিরে পাঠিয়েছিলেন। হিটলারের পরিকল্পনা ছিল ইহুদিরা হবে জার্মানির শ্রমিক, কখনও অফিসার হতে পারবে না। তাদের সমূলে বিনাশ করার পরিকল্পনা ছিল না। যুদ্ধের আক্রমণ, অসুখ-বিসুখ, খাদ্যাভাব ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ইহুদি ও অ-ইহুদি বহু মানুষ মারা যায়। কিন্তু যুদ্ধের পর ইহুদিরা হলোকস্টের গল্প জোরে সোরে চালু করে।

আশ্চর্য ব্যাপার হলো যে, হিটলারের উত্থানেরও বহু আগে সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইহুদি যায়নবাদী গোষ্ঠী ‘ষাট লক্ষ ইহুদি মহাবিপদে আছে’ ‘হলোকস্ট’ এসব শব্দ ব্যবহার করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতেই ১৯০৩, ১৯০৫, ১৯০৭, ১৯১৪ খৃস্টাব্দে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে) ‘হলোকস্ট’ শব্দটি একাধিকবার এসেছে এবং ‘ষাট লক্ষ ইহুদি’র দুঃখগাথার কথাও এসেছে। কাজেই এ ‘হলোকস্ট’ হিটলারের তৈরি কিছু ছিলো না। যায়নবাদী ইহুদিরা বহু বছর ধরে ফিলিস্তিন দখলের উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের দুঃখ কষ্টের মিথ্যা গল্প ফেঁদে আসছিলো। অবশেষে হিটলারের সময় এ মিথ্যাটিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। প্রমাণিত হয়েছে যে, এ ষাট লক্ষ সংখ্যাটি আগে থেকেই বলা হচ্ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের কারণে মোট ইহুদি মৃত্যুর সংখ্যা বাস্তবে আরও কম। সেটা মোটামোটি বিশ বা ত্রিশ লক্ষ। বিশ বা ত্রিশ লক্ষ মৃত্যুও কম নয়। কিন্তু এর পাশাপাশি চার কোটি নব্বই লক্ষ অ-ইহুদির কথা কেউ মনে রাখে নি। আজ প্রমাণিত হয়েছে ‘হলোকস্ট’ বা শোয়াহ বলে কিছু ছিলো না।

বিংশ শতাব্দীর ফিলিস্তিন
বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে ফিলিস্তিনে সংগঠিত যায়নবাদী সমস্যার সূত্রপাত। তখন অস্ট্রিয়ার যায়নবাদী সাংবাদিক ‘থিওডোর হার্জল’ খৃস্টানদের সহযোগিতায় একটি আন্তর্জাতিক ইহুদি যায়নবাদী সংস্থা গঠন করেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও কূটনীতিক ড. হেইম ওয়েজম্যান এবং অন্যান্য ইহুদি নেতাদের প্রচেষ্টায় বিশেষ করে মার্কিন যায়নবাদী ইহুদিদের সাহায্যে এই সংস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সংস্থা তাদের বৃটিশ-মার্কিন সমর্থকদের কাছে ইহুদিদের জন্যে একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি করে। বৃটিশরা ১৯০৩ খৃস্টাব্দে এই সংস্থাকে প্রস্তাব করে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল কেনিয়া বা উগান্ডায় একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু যায়নবাদী ইহুদিরা তা প্রত্যাখ্যান করে। তারা ১৯০৫ খৃস্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের বেইসলির বৈঠকে তাদের ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়ে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনসহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের ম্যান্ডেটে। ১৯১৭ সালের ২নভেম্বর বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদিবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। বেলফোর ঘোষণার ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় বৃটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর বৃটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব শূন্য করার জন্য ভালোভাবে কাজে লাগায় ইহুদি বলয় দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। ১৯১৭ খৃস্টাব্দে বৃটিশরা যখন ফিলিস্তিন দখল করে তখন সেখানে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ জমির মালিক ছিলো মুসলমান, বাকি ১০ ভাগ ছিলো ইহুদি-খৃস্টানদের। ১৯১৮ খৃস্টাব্দের হিসাবানুসারে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা পনের হাজারে উন্নীত হয়। যা ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ খৃস্টাব্দে ৩৫ হাজারে পৌঁছে। ১৯৩১ সালে ইহুদিদের এই সংখ্যা প্রায় ৪গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০হাজারে পৌঁছায়। এভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়।

বৃটিশরা একদিকে ইহুদিদের জন্য খুলে দেয় ফিলিস্তিনের দরজা, অন্যদিকে বৃটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনীদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে অনেক প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। তার মধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনীদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল তখন পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য গুপ্ত সংগঠন হাগানাহ বেছে নেয় আত্মহনন পন্থা। ১৯৪০ সালে এসএস প্যাটৃয়া নামক একটি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬জন ইহুদিকে হত্যা করে। ১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে ৭৬৯জন ইহুদিকে হত্যা করে। উভয় জাহাজে করে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসছিল আর বৃটিশরা সামরিক কৌশলগত কারণে জাহাজ দুটিকে ফিলিস্তিনের বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছিল না। হাগানাহ এভাবে ইহুদিদের হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করলো। পাশাপাশি ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আরবদের উচ্ছেদকরণ চলতে থাকে খুব দ্রুত। এর ফলে ২০ লাখ বসতির মধ্যে বহিরাগত ইহুদির সংখ্যা দাঁড়ালো ৫ লাখ ৪০হাজার। এ সময়ই ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোট গ্রহণ হয় তাতে ৩৩টি রাষ্ট্র পক্ষে, ১৩টি বিরুদ্ধে এবং ১০ টি ভোট দানে বিরত থাকে। জাতিসংঘের তৃতীয় অধিবেশনে ১৮১ নং প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেল ভূমির ৫৬% আর ফিলিস্তিনীরা পেল ৪৪%। তবে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত। এতে ভবিষ্যতে ইহুদিরা সীমানা বাড়াতে পারে। ফলে ইসরাঈল প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত হলেও উপেক্ষিত থেকে যায় ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের মাধ্যমে পাস হয়ে যায় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। প্রহসনের নাটকে জিতে গিয়ে ইহুদিরা হয়ে ওঠে আরো হিং¯্র। তারা হত্যা সন্ত্রাসের পাশাপাশি ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে রাতে তাদের ফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন কাটা, বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, জোর করে জমি দখল এবং বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতন করে মৃত্যু বিভীষিকা সৃষ্টি করতে লাগলো। যার ফলে লাখ লাখ আরব বাধ্য হলো দেশ ত্যাগ করতে। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দের ১৪মে বৃটিশ ম্যান্ডেট শাসনের অবসান হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পূর্বে রাত ১২টা একমিনিটে যায়নবাদী ইহুদি নেতা ডেভিড বেন শুরিয়ান কর্তৃক ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্বাধীন রাষ্ট্র ‘ইসরাঈল’ ঘোষণা করলো। ১০মিনিটের ভেতর পুঁজিবাদী আমেরিকা স্বীকৃতি দিল, অতঃপর সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া।

খুনরাঙ্গা পথে ফিলিস্তিন
ইসরাঈল স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরদিনই মিশর, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক-ইসরাঈলে সামরিক হামলা চালায়। ইউরোপীয় উপনিবেশ থেকে সম্প্রতি মুক্ত হওয়া এসব আরবদেশ সামরিকভাবে সে সময় তেমন একটা শক্তিশালী না হওয়ায় ইসরাঈলকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৯ সালের জুলাইতে সিরিয়ার সাথে আর্মিস্টিস (যুদ্ধবিরতি) চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইসরাঈল-আরব যুদ্ধের অবসান ঘটে। তবে ইসরাঈল তার সার্বভৌমত্বকে ধরে রাখতে সমর্থ হয় এবং ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে নিজেদের রাষ্ট্র সীমানা ১৯৪৭-এর জাতিসংঘের অনুমোদিত বিভাজন ম্যাপের চেয়ে নূন্যতম আরও ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়। আরব-ইসরাঈল যুদ্ধকালীন ইসরাঈল নিজস্ব ভূভাগ (জাতিসংঘের ম্যাপ অনুযায়ী) ও দখলকৃত এলাকা থেকে মুসলিম অধিবাসীদের ঢালাওভাবে বিতাড়ন করে এবং নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মুসলমানদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি করে।

মিত্রদের সহযোগিতা ও আশকারায় দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইসরাঈল। ষাটের দশকে পারমাণবিক বোমার মালিক বনে যায় তারা। দখলদারি ও বর্বরতার ব্যারোমিটার বাড়তে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাঈলের একগুঁয়েমি ও নৃশংসতায় ফিলিস্তিনে রক্তগঙ্গা বইতে থাকে। আরব-ইসরাঈলের মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরও তিনটি যুদ্ধ হয়। এতে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।

মুক্তির সংগ্রামে ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনে যায়নবাদী আধুনিক সংঘাত এখান থেকেই শুরু। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দে ইসরাঈল পশ্চিমাদের প্রকাশ্য সহযোগিতায় আরব দেশগুলোর ওপর আক্রমণ করে ফিলিস্তিনের ২৬হাজার ৩শ ২৩বর্গমিটারের মধ্যে ২০হাজার ৮শ ৫০বর্গমিটার ভূ-সম্পত্তি দখল করে ফিলিস্তিনীদেরকে নিজ মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করে দিলো। ফিলিস্তিনের মাটিতে ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘিত হতে শুরু হলো মানবতা, অথচ জাতিসংঘ নামক সংস্থা বোবা শয়তান হয়ে রইলো। ফিলিস্তিনের মানুষ বাধ্য হয়ে আস্তে আস্তে সংগঠিত হতে থাকলো নিজেদের মাতৃভূমি স্বাধীনতার দাবিতে। এ লক্ষে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও)। ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাত ছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান। তিনি ফিলিস্তিনের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল ফাতাহরও নেতা ছিলেন। অতঃপর ১৯৭২ খৃস্টাব্দে ফিলিস্তিনি জনতার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। পশ্চিমাবিশ্ব, জাতিসংঘ তা মেনে নিতে পারলো না। ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় হামাস। তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক শাখা রয়েছে। মুক্তিকামী এ সংগঠনটি ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দেয় না।

স্বাধীনতার এই তীব্র আন্দোলনকে পশ্চিমাবিশ্ব এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়া সন্ত্রাসী বলে অপপ্রচার শুরু করলো। তবু ফিলিস্তিনীদের আন্দোলন থামেনি। অতঃপর আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শুরু হয় নিরস্ত্রের সঙ্গে অস্ত্রের যুদ্ধ। জালেম-মজলুমের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত শুধু আরববিশ্বকে নয়, আজ গোটা বিশ্বকে সমস্যার মুখোমুখি করে দিয়েছে।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১২ সালের ২৯নভেম্বর জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায় ফিলিস্তিন। এর আগে তারা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘পর্যবেক্ষক ভূখ-’ হিসেবে যোগ দিত। কিন্তু এখন ‘সদস্য নয় এমন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই রায়কে সার্বভৌম ফিলিস্তিনের ‘জন্মসনদ’ বলে অভিহিত করেছেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বিশ্বমানচিত্রের ক্যান্সার ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবীতে ফিলিস্তিনীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে। আর কত রক্ত ঝরলে, লাশের মিছিল কতটা দীর্ঘ হলে, তাদের ভূখ- স্বপ্নের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ধরা দেবে তা এখনো অজানা।

ফিলিস্তিনে ইসরাঈলের সাম্প্রতিক আগ্রাসন
গত ১৪জুলাই ২০১৭ শুক্রবার আল আকসা মসজিদ চত্বরে এক সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন তিনফিলিস্তিনী বেসামরিক নাগরিক ও দুইইসরাঈলি পুলিশ। এ ঘটনার পর ইসরাঈল মুসলিমদের প্রথম কেবলা আল আকসা মসজিদ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এমনকি শুক্রবারের জুমার নামাজও আদায় করতে দেয়া হয়নি মুসলিমদের। ১৯৬৯ সালের পর এই প্রথম এমন কোনো ঘটনা ঘটল। উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বিশ্ব মুসলিম। রক্তক্ষরণ বয়ে যায় মানবতাবাদী প্রতিটি হৃদয়ে। অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানসহ মুসলিমবিশ্বের নেতৃবৃন্দ কঠোর সমালোচনা ও হুশিয়ারির মুখে ইসরাঈল আল আকসা মসজিদ থেকে মেটাল ডিটেক্টর তুলে নিতে বাধ্য হয় এবং সাময়িকভাবে আগ্রাসন বন্ধ রাখে।

শেষকথা
ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কোন পথে? বিশ্বের সুখ শান্তি সমৃদ্ধির প্রয়োজনে তা খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে ফাতাহ-হামাস সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পাশাপাশি আরববিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের সরব ভূমিকাও অনিবার্য। ফিলিস্তিন ট্রাজেডির মূলে যায়নবাদী ইহুদিরা। তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বর্জন করা যেতে পারে। মানুষ আর মানবতাকে রক্ষার চেষ্টা আমাদের সকলকেই করতে হবে।

লেখক-
সাবেক কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন