রাজনীতি মানুষের কল্যাণে একটি মহৎ বিষয় হলেও সবাই রাজনীতি পছন্দ করেন না। এমনকি রাজনীতি করা ভাল মানুষের কাজ নয়, এমন ধারণাও প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে সমাজের এক শ্রেণির ধার্মিক মানুষ রাজনীতিকে শুধু অপছন্দই করেন না, বরং যারা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত তাদের প্রতি খারাপ ধারণাও পোষণ করেন। অথচ আমাদের ইসলাম ধর্ম এ ধারণাকে মোটেও সমর্থন করে না। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা ইসলাম ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োগ ছাড়া ইসলাম পূর্ণাঙ্গতা পায় না। কোন মুসলমানের অপরাজনীতির কারণে ইসলামী রাজনীতিকে অপছন্দ করা বা অস্বীকার করা ইসলাম ধর্মকে অপূর্ণাঙ্গ ধারণা করার শামিল। আর কোন মুসলমান ইসলামকে অপূর্ণাঙ্গ ধারণা করতে পারে না।

ইসলাম কেমন ধরনের রাজনীতিকে সমর্থন করে, এ নিয়ে হয়তো বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু ইসলামে রাজনীতি নেই, একথা শুধু মূর্খ এবং জ্ঞান-পাপীরাই বলতে পারে। কারণ, ইসলাম ধর্মের নবী বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ সা. নিজে একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। মহানবী সা.-এর একান্ত চার সহচর, ইসলামের প্রধান চার খলিফা হযরত আবু বকর রা., হযরত ওমর রা., হযরত উসমান গণী রা. এবং হযরত আলী রা. সবাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তাদের শাসন ব্যবস্থা ইতিহাসে সোনালি যুগ হিসেবে খ্যাত। পরবর্তীতে কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম দুনিয়া তাদের গৌরবের খেলাফত ব্যবস্থা হারিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়েছে। বেশির ভাগ মুসলিম দেশকে ঔপনিবেশিক আগ্রাসী শক্তি গ্রাস করে নিয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শাসন ব্যবস্থা চলছে। কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও সামরিক একনায়কতন্ত্র, কোথাও ঔপনিবেশিক শাসন, আবার কোথাও পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক শাসন চালু রয়েছে। একমাত্র ইরান ইসলামী শাসনব্যবস্থার দাবী করলেও বাকী মুসলিম বিশ্ব সেটাকে শিয়া শাসন হিসেবেই আখ্যায়িত করে থাকে। আজ গোটা দুনিয়ায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি প্রকৃত মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রায় সব মুসলিম শাসকই সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির তাবেদার ও ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে। অথচ যখন প্রকৃত মুসলমানের হাতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল; খোলাফায়ে রাশেদার সেই যুগে বিশ্বের তৎকালীন দুই মহাশক্তি রোম ও পারস্য মুসলিম শক্তিকে সমীহ করতো।

ইসলামের রাজনীতি শুধু মুসলমানের স্বার্থ এবং কল্যাণচিন্তা নয়, বরং গোটা সৃষ্টি জগতের কল্যাণ সাধনই হলো ইসলামী রাজনীতির দর্শন। যে রাজনীতির শিক্ষা দিয়ে রাব্বুল আলামীন রাহমাতুল্লিল আলামীনকে সা. এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। ইসলামের রাজনীতি কোন রকম সাম্প্রদায়িকতা এবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে না। বরং ইসলামের রাজনীতি সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন আন্তর্জাতিকতাবাদকে ধারণ করে। দেশের এক শ্রেণির ধর্মবিদ্বেষী মানুষের আবদার হলো, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি তথা ইসলামী রাজনীতি এদেশে চলবে না। কার্ল মার্কস-মাও সেতুং-এর রাজনীতি চলবে, লেনিন-স্ট্যালিন-এর রাজনীতি চলবে, গান্ধী-আব্রাহাম লিঙ্কনের রাজনীতি চলবে আর মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.- এর রাজনীতি চলবে না, তাও মুহাম্মদ সা.- এর উম্মতদের মেনে নিতে হবে? যারা এদেশে মুহাম্মদ সা.-এর তরিকায় ইসলামের সুমহান আদর্শের আলোকে গণ-মানুষের হৃদয় জয় করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চায়, তাদের অন্যায়টা কোথায়? এটাই ইসলামের রাজনীতি। এটা দোষণীয় কিছু নয়। এটা বরং প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী ফরিজা। এর সঙ্গে প্রচলিত সংঘাত, জিঘাংসা আর প্রতিহিংসার রাজনীতির বিস্তর তফাত। যুগের বিচক্ষণ ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা মরহুম সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. ইসলাম কায়েমের এ রাজনীতির নাম দিয়েছিলেন ‘এবাদতের রাজনীতি’। আরেক যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ মরহুম মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. এ রাজনীতির নাম দিয়েছিলেন ‘তওবার রাজনীতি’। হযরত হাফেজ্জী হুজুরের তওবার রাজনীতিরই পরিণত রূপ হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর ‘এবাদতের রাজনীতি’।

প্রচলিত ধারার ক্ষমতার রাজনীতিতে এ উপমহাদেশের পীর আউলিয়াগণ কখনোই খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবে গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাঁরা যুগে যুগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনে পীর-আউলিয়া এবং উলামা মাশায়েখের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে ফকির মজনু শাহ, মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ, মাওলানা ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা সৈয়দ আহমদ বেরলবী, মাওলানা এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী, দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবী, কুতুবুল আলম মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী, শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী, শায়খুল ইসলাম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী-এর মতো পীর আউলিয়াদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা তাদের ভক্ত, মুরিদ ও শোষিত মজলুম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জালিম আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। উপমহাদেশের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে প্রথাগত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পৃক্ত হয়েছে অনেক পরে, একেবারে শেষের দিকে। প্রথম দিকে সব আন্দোলন সংগ্রাম এবং বিদ্রোহ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পীর আউলিয়া এবং ওলামা শ্রেণী যারা প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে সর্বাগ্রে পীর মাশায়েখগণ ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণ ছিল ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা এবং সামাজিক নেতৃত্ব। উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে পীর আউলিয়াদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। কারণ, পীর আউলিয়াদের দাওয়াত ও প্রচেষ্টার ফলেই উপমহাদেশে মুসলিম সমাজ বিকাশ লাভ করেছে। খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতি, খাজা নিজামুদ্দীন, খাজা খান জাহান আলী, শাহজালাল ইয়ামেনী, শাহ পরান, শাহ মাখদুম, শাহ আমানত, শাহ আলী, শাহ নেয়ামতুল্লাহসহ বিখ্যাত পীর আউলিয়াগণের চেষ্টা সাধনায় ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছে। যে কারণে এখানকার মুসলিম সমাজে পীর আউলিয়াদের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। ব্যক্তিগত ও কিছুটা সামাজিকভাবেও এ অঞ্চলের মুসলিম সমাজ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে বা রাষ্ট্রজীবনে গ্রহণ করতে অধিকাংশ মুসলমানই এখনো প্রস্তুত নয়। অথচ মানুষের প্রয়োজনে এবং মানুষের কল্যাণেই জীবনের সকল পর্যায়ে ইসলামের সুমহান বিধি বিধানের চর্চা হওয়া উচিৎ। আসলে আমরা মুসলমানরাই ইসলামের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারিনি। আমরা দীন ইসলামের খন্ডিত এবং সুবিধাবাদী চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ. মুসলমানদেরকে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করার দাওয়াত দিতেন। তিনি গণমানুষের সামনে দীনের পূর্ণাঙ্গ ধারণা প্রকাশ করতেন। দরদী হৃদয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ দীনের সাধনাই করেছেন তিনি আজীবন। দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার সুবিধাবাদী প্রবণতাকে তিনি বরদাশত করতে পারতেন না। দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার প্রবণতা থেকেই আজ ইসলামকে রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে, অর্থনীতি থেকে, সংস্কৃতি থেকে বিদায় করার চেষ্টা চলছে। অথচ এসব কিছুই দীন তথা ইসলামের বিষয়বস্তুর বাইরে নয়। কিছু উপাসনা আর আরাধনার মধ্যেই শুধু যারা ইসলামকে গন্ডিবদ্ধ মনে করেন; হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ. তাদের ভুল ধারণা শুধরানোর জন্যে আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। তরিকতের লাইনে একজন প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক হয়েও তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ইসলামের আলোকে গড়ে তুলতে। তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন জীবনের সকল পর্যায়ে এবং এ সংগ্রামকে তিনি উত্তম এবাদত মনে করেছেন।

মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. ছিলেন একজন নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিক। পূর্বসূরী আউলিয়ায়ে কেরামের মতো তিনিও প্রচলিত ধারার শুধু ক্ষমতা বদলের রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন-“প্রচলিত পদ্ধতিতে কেয়ামত পর্যন্তও যদি ক্ষমতার হাত বদল হয়, তবুও জনতার মুক্তি আসবে না।” তিনি নীতি ও সাংবিধানিক কাঠামোর পরিবর্তন চেয়েছেন। তিনি রাজনীতি ও প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির গুণগত পরিবর্তন চেয়েছেন। তিনি বলতেন, “শুধু নেতার পরিবর্তন আর ক্ষমতার হাত বদল হলেই যে শান্তি আসতে পারে না, বিগত দিনে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই আমরা বহুবার তার প্রমাণ পেয়েছি।” তিনি বারবার বলেছেন, “আকাশ জমিনের মালিক যেমন আল্লাহ, জীবন-মৃত্যুর মালিক যেমন আল্লাহ, ক্ষমতা-রাজত্ব আর সম্পদের মালিকও তেমনি আল্লাহ, শান্তির মালিকও আল্লাহ। অতএব শান্তি পেতে হলে মানুষের গড়া দুর্বল নীতি বাদ দিয়ে আল্লাহর ইনসাফপূর্ণ নীতিতে দেশ চালাতে হবে।”

তিনি আরো বলতেন, “একমাত্র ইসলামই মানুষের মুক্তির গ্যারান্টি; আওয়ামী লীগ, বিএনপিও যদি ইসলামের ইনসাফপূর্ণ বিধানের আলোকে দেশ চালায়- আমি তাদের খাদেম হয়ে থাকবো। আমি ক্ষমতা চাই না, আমি চাই মানুষের শান্তি।”
পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর পদ্ধতি ও নীতির পরিবর্তনের জোরালো আহবান আঠারো শতকের দার্শনিক শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবির সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের বিপ্লবী আওয়াজেরই প্রতিধ্বনি ছিল। পীর সাহেব রহ. এর রাজনৈতিক দর্শন-চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। সাময়িক স্বার্থ চিন্তায় তিনি কখনো তাড়িত হতেন না। চমক আর হুজুগের রাজনীতি, আবেগ আর হঠকারী রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি ইসলামী রাজনীতির স্বতন্ত্র ধারা বজায় রাখতে চেয়েছেন। তিনি জাতীয় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কথা ভাবতেন।

এ লক্ষ্যেই তিনি শেষ জীবনে জাতীয় ঐক্যের আহবান জানিয়ে ছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতির স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মৌলিক ইস্যুতে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি জাতীয় সমস্যা ও ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে দেশের সচেতন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। তাঁদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতেন। তিনি সব সময় স্পষ্ট কথা বলতেন। কোন বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়ার বা পাশ কাটানোর প্রবণতা তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, ওলামা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শিক্ষকসহ সকল শ্রেণী-পেশার গণমানুষকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা চলিয়েছেন। জাতীয় জীবনের এক দুর্যোগপূর্ণ মূহূর্তে ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ গণমানুষকে মুক্তি ও আলোর পথ দেখাতে তিনি কায়েম করেছিলেন “ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন” নামের একটি গণ-সংগঠন। সংগঠনের নামের মধ্য দিয়েই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, দেশে রাজনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে শাসনতান্ত্রিক সংকট। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মানুষ মানুষের গোলামি থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা বহাল রেখে গোলামির হাত বদল হয়েছে মাত্র। পীর সাহেব চরমোনাই রহ. মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামীনের গোলামি করার আহবান জানিয়ে ছিলেন। এটাই ছিল পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর এবাদতের রাজনীতির মূলমন্ত্র। তিনি মানুষের ভেতরের প্রকৃত মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সমাজের প্রতিটা মানুষ যাতে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করে একজন আল্লাহ প্রেমিক মানবতাবাদী ইনসানে কামেলে পরিণত হতে পারে-সেটাই ছিল এই সাধক পুরুষের সবচেয়ে বড় মিশন। তাঁর রেখে যাওয়া সে মিশন এখনও চালু আছে। আত্মশুদ্ধি ও ব্যক্তিশুদ্ধির এই প্রচেষ্টার ফলে সমাজের বহুসংখ্যক অপরাধী অপরাধের পথ পরিহার করে ন্যায়ের পথে চলছেন। অনেকেই সমাজ বিরোধী, রাষ্ট্র ও আইন বিরোধী, ধর্ম ও নৈতিকতা বিরোধী পথ পরিহার করে শান্তির আলোকিত পথ ধরেছেন। একটি ভাল রাষ্ট্র ও ভাল সমাজ গড়ে তুলতে হলে ভাল মানুষের প্রয়োজন। পীর সাহেব চরমোনাই রহ. সেই ভাল মানুষ তৈরীর জন্যে সবচেয়ে বেশি পেরেশান ছিলেন। এমন একজন মানবতাবাদী দরদী আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা পাওয়াটা ছিল আমাদের জন্যে এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়।

মানুষের মাঝে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, “আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে মানুষ সমাজবিমুখ ও সংসার বিরাগী হয়ে যায়।” মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও দার্শনিক পীর সাহেব চরমোনাই রহ. তাঁর সময়োপযোগী দর্শন-চিন্তা ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে তা নতুন করে ভুল প্রমাণ করেছেন। তিনি তাঁর বৈচিত্রময় কীর্তির মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহকে পাওয়ার সাধনা মানুষকে আরো সমাজমুখী এবং জীবন-জগত সম্পর্কে আরো দায়িত্ব সচেতন করে তোলে। সন্ন্যাস প্রবণতা আর বৈরাগ্য তো দূরের কথা, বরং নিজের মাঝে রাষ্ট্রচিন্তা ও বিশ্বচিন্তার উন্মেষ ঘটে। বিশ্বশান্তি ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেতনা বিকশিত হয়।

২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর এই মহান সাধক, ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুন পুনর্জাগরণের আপোষহীন সংস্কারক মাওলায়ে করীমের ডাকে সাড়া দিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরীর নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এদেশে এবাদতের রাজনীতিকে নতুন মাত্রায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

লেখক
যুগ্ম মহাসচিব
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
ও সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
ইশা ছাত্র আন্দোলন