দেশে-দেশে সহিংসতা আদর্শিক না সন্ত্রাস
ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাক আহমেদ
ক্যানিবালিজম নামক গ্রন্থে মনটোয়েন লিখেন- মৃত্যুর পর মানুষকে ভেজে খেয়ে ফেলার চাইতে, জীবিত মানুষকে খেয়ে ফেলা কিংবা সজ্ঞান ও সচেতন মানুষকে নির্যাতন নিপীড়ন চলানো অনেক বেশি বর্বর কাজ। ইদানিং আমরা এর চেয়ে শতগুণ বেশি বর্বরতা লক্ষ করেছি সারা পৃথিবীর দেশে দেশে সন্ত্রাসীদের সহিংস হামলাগুলোতে। অতি সেকুল্যার ফ্রান্স থেকে নব্য ইসলামমুখী তুরস্ক কিংবা আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের গুলশান ও শোলাকিয়া থেকে আমার প্রিয় মহানবী সা.-এর পবিত্র ভূমি মদিনা পর্যন্ত যে সহিংস হামলাগুলো হল- তাতে আমরা সন্ত্রাসের একটা বৈশ্বিক রূপ দেখলাম। নির্মমতা কাকে বলে দেখলাম। দেখলাম সেখানে পৈশাচিকতা কাকে বলে। তাতে দেখলাম জঘন্য বর্বর হত্যাযজ্ঞ কত ধরনের হতে পারে। তাতে এও দেখলাম আতংকিত হলে মানুষ কত অসহায় হতে পারে। এককথায় নিরাপরাধ মানুষের দেহ নিয়ে, প্রাণ নিয়ে রক্তের এক হোলি খেলার উৎসব দেখলাম। আজকে দেশে দেশে যে সহিংস হামলাগুলো হচ্ছে এইগুলোকে স্রেফ সন্ত্রাস বলতে হবে।
আজকাল সন্ত্রাসী হামলা কেমন যেন সন্ত্রাসীদের ফ্যাশানে পরিনত হয়েছে। সে এক আজব ব্যাপার। সন্ত্রাসী হামলাগুলো যারা করছে- তাদেরকে কেউ বলেন সন্ত্রাসী, কেউ বলেন জঙ্গি, কেউ বলেন উগ্রবাদী, কেউ বলেন চরমপন্থ’ী, কেউ বলেন মৌলবাদী, কেউ বলেন বিপদগামী, কেউ বলেন গোড়ামী আবার কেউ বলেন বোমাবাজ, কেউ বলেন আততায়ী, কেউ কেউ বলেন ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি ইত্যাদি। যে যা বলুক, আমরা বলবো- এরা উগ্রবাদী। আর উগ্রপন্থ’ীর অপরনাম সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসী তো সন্ত্রাসীই তাকে আর কীবা বলা যায়।
এখন পর্যন্ত বিশ্বে সন্ত্রাসের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায়নি। আসলে সন্ত্রাস একটা আপেক্ষিক বিষয়। মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ ফেকাহ পরিষদ ‘মুজাম্মাউল ফেকহিল ইসলামী’র প্রথমসারির মুফতিগণ সন্ত্রাসের একটা ব্যাখা দিয়ে বলেন- অন্যায়ভাবে কোন ব্যক্তি, দল অথবা রাষ্ট্র যদি অন্য কোন ব্যক্তির জান-মাল বা ইজ্জতের উপর অযথা হস্তক্ষেপ করে, শক্তি প্রয়োগ করে, ত্রাস সৃষ্টি করে এটাই সন্ত্রাস। বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হল- পৃথিবীর কোন প্রান্তে কোন সন্ত্রাসী হামলা হলেই পশ্চিমরা আর তাদের দোষারূপ ইসলাম ও মুসলমানদের দিকে প্রথমে আঙ্গুল উঁচু করে দোষারূপ করার অপচেষ্টা চালায়।
মনের রাখতে হবে, ধর্ম কখনো সন্ত্রাস শিক্ষা দেয় না। ধার্মিক ব্যক্তিত্ব কখনো সন্ত্রাসী হয় না। আবার সন্ত্রাসীও কখনো ধার্মিক হয় না। আর সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম নেই বরং সন্ত্রাস হলো তাদের আসল ধর্ম। দয়া-মায়াহীন পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিরাই মূলত এইসব সন্ত্রাস করে থাকে। বিশেষ করে ইসলামে সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই। মহাকবি আল্লøামা ইকবাল রহ: এর ভাষায়- ‘উনহিকা মাহফিল সাঁওয়ার তা হু, চেরাগ মেরি হ্যায় রাত উনকি, উনহিকা মতলব কাহ্রাহা হুঁ, জবা মেরী হ্যায় বাত্ উনকি’। অর্থাৎ- এই অনুষ্ঠান আমার নয়, অন্যজনের আর অন্যজনের রাতের অন্ধকার দূর করার জন্য আমি আমার প্রদীপ জালাই। অন্যজনের রাতেরই অন্ধকার দূর করার জন্য আমি আমার জিহŸা ব্যবহার করি। আসলে ইসলাম আমাদেরকে দয়া মায়া-মমতা শেখায় আর সহনশীলতা শেখায়।
প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ড. খুরশিদ আহমদ ‘গোড়ামি অসহনশীলতা ও ইসলাম‘ গ্রন্থে লিখেন- ইতিহাস বলছে যে, ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মহীন শাসনাধীনে অসহনশীলতা অধিকতর ভয়াবহ। অধিকতর সন্ত্রাসদের এবং অধিকতর অমানুষিক রূপ ধারন করে। এই সত্যের সামনে ধর্ম অসহনশীলতার জন্ম দেয়। এই যুক্তি আর পালে বাতাস পায় না।
ড. এন. কে সিংহ তার ‘ইসলাম: এ রিলিজিয়ন পিস’ গ্রন্থে লিখেন ইসলাম সহিংসতার ধর্ম নয়। সহিংসতা ইসলামের অংশ নয়। ইসলাম শব্দটি সহিংসতার ধারনাকে অ¯^ীকার করে। একজন সত্যিকার মুসলিম মহান আল্লহর হুকুমের সামনে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এবং পৃথিবীর শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে বেঁচে থাকে আর মৃত্যুবরণ করে। মূলত সন্ত্রাসী হামলা করে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা আর আতংক সৃষ্টি করা ইসলামে একেবারে নিষিদ্ধ।
পবিত্র কোরআনে বলা আছে- একজন মানুষকে হত্যা করা মানে পৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যা করা এক সমান বুঝায়। মহান আল্লøাহ পবিত্র কালামেপাকে বলেন (বৈধ কারণ ব্যতীত) কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন সমস্ত মানুষকেই হত্যা করলো। আর যদি কেউ কাউকে জীবন দান করে তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে জীবন দান করলো (সূরা মায়িদা)।
বিশ্বনবী সা. হাদীসে পাকে বলেন- মুমিন ব্যক্তি আল্লøাহর নিকট অবস্থানকারী ফেরশতাদের চাইতেও সম্মানিত। অন্য কোনো মুমিন ব্যক্তির রুহের বিনিময় ব্যতীত তাকে হত্যা করা অপেক্ষা দুনিয়াটা ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লøাহর নিকট অনেক সহজ। পৃথিবীর উত্তর দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে কিংবা পৃথিবীর কোণায় কোণায় হতে পারে, পৃথিবীর মধ্যখানে যে সকল সন্ত্রাস হচ্ছে- সকল সন্ত্রাস নির্মূলের লক্ষ্যে ইসলামে জিহাদের বিধান রাখা হয়েছে। আজকে সেই পবিত্র জিহাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তি, তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা আর প্রাচ্যবিদরা যে সকল অপপ্রচার চালাচ্ছে অপবাদ দিচ্ছে তাকে মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না।
বৃটিশ রাজনীতিবিদ ও সাবেক কনজার্ভেটিভ এমপি লর্ড নরম্যান বলেন- আমি মনে করি না ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদের কোন যোগসূত্র আছে। আমি মনে করি, জিহাদ শব্দটি ভ্রান্তভাবে বুঝা হচ্ছে। জিহাদের দুটি অর্থ হতে পারে। এক. ইসলাম হুমকির কবলে পড়লে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য পরিচালিত যুদ্ধ। দুই. জিহাদ একটি অধ্যাত্মিক বিষয় নফসকে কাবু করা এবং আরো ভালো ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টা করা।
আসলে জিহাদ ইসলামে মহান আল্লøাহর পবিত্র বিধান। আমাদের মহান পবিত্র ইবাদত। যতই গুজুব ছড়াক ওরা, আমরা বলব- সন্ত্রাসের সাথে জিহাদের নিকটতম সম্পর্ক বাদই দিলাম বরং দূরতম সম্পর্কও নেই। আর সন্ত্রাস থেকে জিহাদ শুধু দূরে নয়, বলতে গেলে যোজন যোজন দূরে। আসল কথা হল, জিহাদ কখনো সন্ত্রাস নয় আর সন্ত্রাসও কখনো জিহাদ নয়। আজ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিমরা যেভাবে নির্যাতিত নিপড়ীত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানে যদি একজন মুসলিম কিশোর আমার সাথে একটি ঢিলও ছুঁড়ে তাহলে সেই হয়ে যায় জিহাদী, সেই হয়ে যায় সন্ত্রাসী যোদ্ধা কিংবা সে হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী।
সাহিত্যিক আবু জাফর ‘অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় কথা” বইয়ে খুব সুন্দর উদারহরণ দিয়ে লিখেছেন- অসংখ্য ফুলে-ফলে পরিভ্রমণ করে বহু পরিশ্রমে মৌমাছি তার মৌচাকে মধু সঞ্চয় করে রাখে। নির্দয়, দস্যুর মতো বাওয়ালি যখন মৌচাকে হানা দেয়, ক্ষুদ্ধ রাগাšি^ত মৌমাছি তার মধু ও মৌচাক রক্ষা করতে যদি বাওয়ালিকে দংশন করে। সেটা কি সন্ত্রাস? আসলে কে সন্ত্রাসী? দস্যু বাওয়ালি, নাকি বিক্ষুদ্ধ মৌমাছি? কী অদ্ভুত পরিহাস। পাশ্চাত্যের বাওয়ালি মুসলিম বিশ্বের সর্ব¯^ লুণ্ঠনে মেতে উঠবে, (যা দেখে ইবলিসও লজ্জা পায়)। তারা নিষ্পাপ নিরাপরাধ! আর যারা আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ করবে তারা সন্ত্রাসী!!
এক উর্দুকবির ভাষায়- ‘ও কতল ভি কয়াত চর্চা নাহি হোতা, হাম আহভি করয়িত বদনাম হো জা তা’। অর্থাৎ- সে খুন করে কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ তার সমালোচনাও করে না। আহত হয়ে যন্ত্রণাকাতর শব্দ আমার মুখে উচ্চারিত হলেই চারদিকে আমার দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে।
অন্য ধর্মের লোকের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টাই দেখি, সৈয়দ আবুল মাকসুদ প্রথমআলোর এক উপসম্পাদকীয়তে লিখেন- নরওয়ের স্যাভার্স ব্রেইভিক যখন উটোয়া দ্বীপে নরওয়েজিয়ান লেবার পার্টির খুবক্যাম্পে বন্ধুক থেকে গুলি ছুঁড়ে ৭৭ জনকে হত্যা করে, তখন সরকার বলল- সে ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসী, খ্রিষ্টীয় মৌলবাদের নামটিও উচ্চারণ করা হলো না, যদিও যুবকটি খ্রিষ্টান মৌলবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী। পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই দ্বিমুখী নীতি থেকে আমাদের সহসাই বেরিয়ে আসা উচিত। না হলে শান্তি সদূর পরাহত।
মধ্যপ্রাচ্যের বুদ্ধিজীবী একজন তার আচারণে গোড়ামি ও সহিংসতা’ গ্রন্থে এর একটা কারণ ব্যাখা করে লিখেন- বর্তমান যুগের গোড়ামি, সহিংসতা ও সন্ত্রাসী আন্দোলন তা কখনো কম্যুনিস্ট বা সমাজতন্ত্রের রূপ ধারন করেছে। কখনো জাতীয়তাবাদের, কখনো ধর্মীয় পরিচয়ের তাই আমরা সহিংস আন্দোলন সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকতে পারি না। যেমন- ইতালির লালবর্ণের আন্দোলন, জার্মানির বাছের সাইনহোফের আন্দোলন, জাপানের আউসের আন্দোলন, উত্তর আইরল্যান্ডের গণতন্ত্রিক দলের আন্দোলন, স্পেপেনের কয়েক জেলার ঈতা সংগঠনের আন্দোলন, ইউনানের ১৭ নভে¤^রের আন্দোলন, ভরতের উগ্রবাদ হিন্দুদের আন্দোলন, দক্ষিণ আমেরিকার বাম বিপ্লøবীদের আন্দোলন বরং আমেরিকাতে ৫১টির মত সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। আমরা এখানে তাদেরকে একথা বুঝাতে চাচ্ছি যে, এটা (সন্ত্রাসবাদ) কোন জাতি বা ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নয় বরং প্রত্যেক জাতি ও ধর্মের সাথে ও সম্প্রদায়ের মাঝে এ গোড়ামির অস্তিত্ব রয়েছে।
খ্যাতিমান চিন্তাবিদ আজিজুল হক বান্না এক প্রবন্ধে বলেন- কতক মূসলমান, যারা আত্মঘাতী বোমা হামলার ¯^ারথী হয়েছেন কিংবা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন তার পিছনে পশ্চিমা শক্তির প্ররোচনা ও অবদমন নীতির হাত রয়েছে। ইসলাম সাধারণভাবে কোন নিরপরাধ মানুষ হত্যা বা সম্পদ বিনষ্টের অধিকার দেয় না। সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নিরূপণ না করে সন্ত্রাস বা চরমপন্থার জন্য ইসলামকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো পশ্চিমাদের একটা কৌশল।
আজ পৃথিবীর কোন প্রান্তে কোন অঘটন ঘটলেই মুসলমানদের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা আমরা দেখতে পাই আর ইসলামের বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে গভীর ষড়যন্ত্রের আঁচও পরিলক্ষিত হয়। আসলে পৃথিবীর বুকে দ্রুত বিস্তারকারী ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। আর জ্যামিতিক হারে বাড়ছে পৃথিবীতে মুসলিমদের সংখ্যা। ১৯৮৬ সালের রীডার্স ডাইজেস্টের এক পরিসংখ্যান মতে পৃথিবীতে ইসলাম বেড়েছে ২৩৫% হারে। আর খ্রীষ্টবাদ বেড়েছে মাত্র ৪৭% হারে।
সবচেয়ে বড় কথা ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। আর ইসলামের যে সারা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা আছে সে অনেক আগেই পরিক্ষীত। এসব কারণেই আজ পশ্চিমাদের বড় মাথাব্যথা। পশ্চিমাদের গুরু সামুয়েল পি হাটিংটন একটি বই লিখে তাদের মাথা ব্যথা আরও বাড়িয়ে দিলেন। হাটিংটন হলেন আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক পরিচালক। এছাড়া আমেরিকার রয়েল পলিসি নামক পত্রিকার প্রতিষ্ঠিতা ও কো-এডিটর। তিনি ১৯৯৭ সালে The Clash of Civilization and the Remaking of Word order অর্থাৎ সভ্যতার সংঘাত ও পৃথিবীর পুনর্গঠন নামক একটি বই লিখেন। উক্ত বইটি আমাদের মাঝে The Clash of Civilization অর্থাৎ সভ্যতার সংঘাত নামে বেশি পরিচিত। পৃথিবীতে এটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সারা পৃথিবীর মানুষ নড়েচড়ে বসে। আর ইহুদী সরকার ইহুদী প্রভাবিত বিশ্বেরনেতা ও বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ করে ইহুদী প্রাভাবিত পত্রিকাগুলো বইটির প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে, উক্ত বইয়ে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে আমেরিকা তথা পশ্চিমাদের পরামর্শ দিয়ে হাটিংটন লিখেন- ধর্মনিরপেক্ষ উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আমেরিকার সুযোগ্য নেতৃত্বে বর্তমানে সারা বিশ্বে সার্বজনীন সম্মান মর্যাদার আমলে আসীন হয়েছে।
বর্তমানে দুনিয়াব্যাপী আমেরিকাই পাশ্চাত্য সভ্যতার নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার দুনিয়ার সকল জাতির কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে এক বিশ্বরূপ ধারণ করেছে। অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, এই সভ্যতা বর্তমানে সারা দুনিয়ার ওপর বিজয়ী হয়েছে এবং সকলেই এর দ্বারা প্রভাবিত। সমাজতন্ত্রের পতনের পরে পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ উদার গণতন্ত্র সারা দুনিয়ার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম, ইসলামী দল ও সংগঠনসমূহ যে গতিতে সম্মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি বিশেষ, পাশ্চাত্যের নেতৃত্বে নতুন বিশ্ব গড়ার পথে ইসলামই একমাত্র শক্তি, যা পাশ্চাত্যের নেতৃত্বে গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সমাজতন্ত্র ছিলো একটি সাময়িক সমস্যা বিশেষ, এখন তা শেষ, কিন্তু ইসলাম গত ১৫শত বছরব্যাপী ¯^কীয় শক্তিতে পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে দ্ব›েদ্ব লিপ্ত রয়েছে। সভ্যতার দ্ব›েদ্ব ইসলাম বেশ শক্তিশালী বলেই প্রমাণ হচ্ছে। আর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে এর সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টির ক্ষমতা একমাত্র ইসলামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সুতরাং নতুনভাবে যারা দুনিয়াকে গড়তে আগ্রহী, তাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে এবং ইসলামের উত্থানকে যে কোন প্রকারে প্রতিহত করার পরিকল্পনা এখন গ্রহণ করতে হবে।
হাটিংটনের কথামতে পশ্চিমারা অজা সারা পৃথিবীতে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমেছে। মুসলমানদের নির্মূল করার লক্ষ্যে একের পর এক ষড়যন্ত্রের ছক আঁকছে। মুসলিমদের সাজানো বাগানগুলো উচ্ছেদ করে ফেলা হচ্ছে। যেসব মুসলিম দেশ সভ্যতার পরীস্থান যেগুলোকে বার বার ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। যেসব মুসলিম দেশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে আর দেশে উন্নয়ন করছে, সেগুলোকে পিছন দিক থেকে লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোর ভিতরে আজ উগ্রপন্থী সৃষ্টি করা হচ্ছে, গ্রæপ উপগ্রæপ কিংবা দল- উপদল সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে একচেটিয়া অপ্রচার চালাচ্ছে।
কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় এক উপসম্পদকীয়তে লিখেন- দেশে দেশে কিছু দেশীয় উগ্রবাদী ও জঙ্গি থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি তৎপরতার রূল উৎপত্তিস্থল আফগানিস্তান, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ। যুগ যুগ ধরে পশ্চিমা শাসন-শোষণ ও বঞ্চনার শিকার এই অঞ্চলের মানুষেরা। অত্যাচার ও বঞ্চনার শিকার হতে হতে তাদের জীবনে একপ্রকার হতাশা চলে আসে। এই হতাশাটি তাদেরকে উগ্রপন্থার দিকে টেনে নেয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিসহ অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, দেশে সুশাসনের অভাবেই উগ্রবাদ সৃষ্টি হয়, আবার অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, আমেরিকা নিজের অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখার সাথে দেশে দেশে উগ্রবাদ সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য যে, গত ৬ই জুলাই ২০১৬ তারিখে যুক্তরাজ্য প্রকাশিত চিলকট রিপোর্টে বলা হয়- ইরাক যুদ্ধ বেআইনী ও অন্যায় ছিল, ভুল তথ্য উপস্থাপন করে পশ্চিমা শক্তি ইরাক নামক সাজানো গোছানে সুন্দর দেশটাকে মৃত্যুপুরীতে পরিনত করে ফেলল। মুসলমানদের ক্ষতি তো হলোই আরও অপূরণীয় ক্ষতি হল সারা বিশ্বের, সিরিয়া, ইরাকের এই ধ্বংসস্তুপ থেকেই সারাজাহানের আতংক তথাকথিত আইএস সৃষ্টি করা হল, লাভটা কী হল? হয়তোবা যারা অসৎ ব্যবসা করে তাদের লাভ হচ্ছে। কিন্তু ঐদিকে সারা পৃথিবীর মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া তাদের দেখাদেখি আরও বিভিন্ন দেশে উগ্রবাদী সংগঠন সৃষ্টি হচ্ছে।
সাপ্তাহিক নেশন পত্রিকার ভাষ্যকার ইউসুফ মুনাওয়ার এর মতে গনগনে চুলায় পানি গরম করতে গেলে তাতে এক সময় বুদবুদ দেখা দেবে। জঙ্গিবাদ হলো ওই বুদবুদদের মতো। এই উগ্রবাদীরা ইসলামের অপব্যাখা করে বেহেশত পাওয়ার ভুল আশ্বাস দিয়ে ¯^প্নবাজ তরুণদের কৌশলে মগজ ধোলাই করে বিপদগামী করেছে আর উগ্রবাদী হতে সাহায্যে করেছে।
সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ড. স্ট অ্যাট্রনের মতে- বিদেশি জঙ্গি যোদ্ধাদের ৯৫ শতাংশ পরিবার ও বন্ধুদের মাধ্যমে আইএস নিয়োগ করছে, তাদের তারা মসজিদ থেকে নেয়নি, তাহলে বোঝাগেল, এসব জঙ্গিরা ইসলামের কেউ নয় বরং ইসলামের বড় দুশমন। ইসলামের সাথে এই উগ্রবাদীদের সম্পর্ক আছে বললে মারত্মক ভুল তো হবেই যাকে বরং সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। অথচ অন্যদিকে সন্ত্রাসের ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলোতে অন্য কথা বলছে। ইতিহাসে আছে, খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের হাতে বিংশ শতাব্দীতে বিশ কোটি মানুষ খুন হয়েছে।
লোন ওয়াচ ডটকম নামক ওয়েব সাইটের পরিসংখ্যান মতে ইউরেপীয় ইউনিয়নে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দশমিক ৪ শতাংশ মুসলিমদের দ্বারা আর ৯৬ ভাগ অমুসলিমদের দ্বারা সংঘঠিত হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় যত সন্ত্রাসী হামলা ঘটেছে তার ৬ শতাংশ মুসলিম আর ৪২% ল্যাটিন, ২৪% বামমনা, ৭% ইহুদী, ৫% সমাজতন্ত্রী ও ১৬% অন্য চরমপন্থী গ্রæপগুলো দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।
ইহুদিমালিকানধীন ‘ইকোনোমিকস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পৃথিবীতে গত শতাব্দীতে বা বর্তমানে যে সব সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, গেুলোতে ৬০ ভাগ অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে আমেরিকার। আর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ হলো সন্ত্রাসী হামলাগুলোর অর্থ, প্রশিক্ষণ ও মূল মদদদাতা।
সুন্দর এই পৃথিবীতে আসলে সন্ত্রাসের জন্মদাতা, আশ্রয় প্রশয়দাতা ও ইন্ধনদাতা হলো কুটিল ইহুদিজাতি। জারজ ইহুদিদের কালো হাত আজ নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের রক্তে রজ্ঞিত। ইহুদি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মধ্যে ওয়ার্ড জায় লিকট অরগানাইজেশন, ফ্রীম্যামন, হেগনা, ইরগুল, জীউইম, এজেন্সী কাহাল, জামেয়া ইয়াহুদীয় ইত্যাদি নামে সভ্যতা বিধ্বংসী সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, বিভিন্ন মতবাদ মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার গোড়াতেই রয়েছে এই ইহুদিরা। সেটা হোক পুঁজিবাদী, হোক সমাজতন্ত্র কিংবা হোক না অন্য কোন মতবাদ, কুটিল ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের কারণে এই ইহুদি জাতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে বিতারিত হওয়ার একটা চিত্র আছে। ইংল্যান্ড থেকে ১২৯০ সালে, ফ্রান্স থেকে প্রথমে ১৩০৬ সালে, দ্বিতীয় বার ১৩৯৪ সালে, বেলজিয়াম থেকে ১৩৭০ সালে ইতালি থেকে ১৫৪০ সালে, জার্মানি থেকে ১৫৫১ সালে বিতারিত হয়। আর হিটলার তাদেরকে পাইকারীহারে হত্যা করে। এই হলো কলংকিত জাতির কলংকিত ইতিহাস।
আর মাওবাদী, লেনিনবাদী, বামপন্থীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অঘোষিত সন্ত্রাস-সংগ্রামের মাধ্যমে উগ্রবাদী তথা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যাদের হাতে অগণিত নিরীহ মানুষের অকালে প্রাণ ঝরছে, যা বর্ণনার বাইরে। যাক, অতীত ইতিহাসের এই জাতীয় পৃষ্ঠাগুলো উল্টালে আর প্রতিদিনকার ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘনাবলী বিশ্লেøষণ করলে মুসলিম হিসেবে নিজের প্রতি নিজের বেশ করুণা হয়। মনে মনে ভাবি, যতদোষ নন্দঘোষ। হঠাৎ দীর্ঘশ্বাসের সাথে মনের অজান্তেই কখন যে মুখে দিয়ে বের হয়ে যায়- আহরে মুসলমান!
বিপ্লøবী সংগীতশিল্পী আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ. ঠিকই গেয়েছেন- সন্ত্রাস কাকে বলে জানকি? ওরাই দেশের সব মান কি? আসলে মূসলমানরা হয়তো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার নয়তো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের শিকার। আপাতত এটাই আমাদের ভাগ্যের লিখন বলে বলা যায়। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কোন মুমিনের আদর্শ সন্ত্রাস নয়, কোন মুসলমানের আদর্শও সন্ত্রাস নয়। সর্বপ্রকার ইসলামের আদর্শও সন্ত্রাস হতে পারে না। এখানে বলে রাখা ভালো, সন্ত্রাসীদের কোন আদর্শ নেই বরং সন্ত্রাসই হল তাদের মূল আদর্শ। তবে চরমপন্থীদের আদর্শ সন্ত্রাস হতে পারে বামপন্থীদের আদর্শ সন্ত্রাস হতে পারে, নৈরাজ্যবাদীদের আদর্শ সন্ত্রাস হতে পারে কিংবা খারিজীবাদীদের আদর্শ সন্ত্রাস হতে পারে। কিন্তু কোন ইসলামী সংগঠন বা দলের আদর্শ সন্ত্রাস হতে পারে না। সন্ত্রাসের সাথে তাদের নাম জড়িয়ে ফেলা এটা মিথ্যা বৈ আর কিছুই নয়, বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইসলামী দলগুলো ¯^াভাবিক প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইসলামী হুকুমতে বিশ্বাসী, অ¯^াভাবিক পন্থা তথা সন্ত্রসী পন্থায় ইসলামী হুকুমতে তারা বিশ্বাসী নয়। পশ্চিমা নেতা আব্রাহাম লিংকনের নিচের কথা দিয়ে শেষ করছি- তুমি সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পার এবং কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা তোমার পক্ষে সম্ভব, কিন্তু তুমি সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পার না।
স্যোসাল লিংকসমূহ