ক্রান্তিকালে মুসলিম উম্মাহর কর্মপন্হা

মাওলানা লেয়াকত আলী

ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে মুসলিম উম্মাহ। একদিকে বিশ্বের সব শক্তি একজোট হয়েছে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব মুছে ফেলতে। এজন্য পরিকল্পনা, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাত্রায় সংযোজন ঘটছে অবিরত। অন্যদিকে মুসলমানেরা অভ্যন্তরীন বিবাদ ও বিসংবাদে জর্জরিত। মুসলিম দেশগুলোতে জনগণ ও শাসক শ্রেণীর মধ্যে বিস্তর ফারাক। আর অমুসলিম দেশগুলোতে মুসলমানদের অস্তিত্বের সঙ্কট।

মুসলমানদের দীর্ঘ দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন সঙ্কট, সামরিক ও বুুদ্ধিবৃত্তিক হামলা, ব্যর্থতা ও পরাজয়ের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু এসব ব্যর্থতা ও পরাজয় ছিল সীমিত পর্যায়ের ও সাময়িক। তারা এক জায়গায় পরাজিত হয়েছেন। আবার অন্য জায়গায় জয়ী হয়েছেন। একটি এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়েছে। নতুন এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যেমন তাতারীদের হামলায় বাগদাদ ধ্বংস হয়েছে, অন্যদিকে উসমানি সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের যখন পরাজয় ঘটেছে, ঠিক একই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সূর্য উদিত হয়েছে। কনস্টান্টিনোপলের বিজয় ও স্পেনের পতন হয়েছে প্রায় একই সময়ে। এভাবে মুসলমানদের জয় ও পরাজয় পাশাপাশি অবস্থান করেছে।

ইতিহাস চর্চা করে জানা যায়, মুসলমানরা যে সব ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছে তা সাময়িক বা তাৎক্ষণিক প্রচেষ্টার ফল ছিল না। বরং তা ছিল ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফল এবং দীর্ঘকালের ধৈর্য ও দৃঢ় সংকল্পের ফসল। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের কথাই ধরা যাক। মুসলমানরা মোট এগারো বার তা অবরোধ করেন। প্রথম অবরোধে অংশ নিয়েছিলেন রাসূল সা.কে যিনি মদিনায় নিজ বাড়িতে মেহমান হিসেবে বরণ করেছিলেন সেই হযরত আবু আইয়ুব আনসারি রাযি.। এ ছিল হিজরি ৫২ সালের ঘটনা। মহানবীর মেজবান অশীতিপর সাহাবি এই অভিযানে ইন্তেকাল করেন এবং তাঁকে নগর প্রাচীরের ছায়ায় দাফন করা হয়। তাঁর কবর এখনো পুরো ইস্তাম্বুলে (কনস্টান্টিনোপলের বর্তমান নাম) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত। প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি বিদেশি পর্যটক আসেন এই মহান সাহাবির কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী খৃস্টান সম্প্রদায়ের শেষ গৌরবের কেন্দ্র জয়ের জন্য মুসলমানদের প্রচেষ্টা ও অভিযান অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর ধৈর্য ও সংকল্পের মুকুল প্রস্ফূটিত হয় এবং ৮৫৭ হিজরি মোতাবেক ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে তুর্কি উসমানি সুলতান মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ে সফল হন। ইতিহাসে তিনি মুহাম্মদ ফাতেহ নামে পরিচিত।

৪৯৪ হিজরিতে খৃস্টান শক্তি ‘বায়তুল মাকদিস’ দখল করে। তখন যেভাবে সেখানে মুসলমানদের পাইকারি হারে হত্যা করা হয় তা মানবতার ইতিহাসে নজিরবিহীন। মুসলমানদের রক্তের বন্যা বয়ে যাওয়ার বিস্তারিত কাহিনী খৃস্টান লেখকরাই বর্ণনা করেছেন। খৃস্টান শক্তির এই দখলদারিত্ব প্রায় নব্বই বছর বহাল থাকে। তারপর ইমাদুদ্দীন জঙ্গি ও নূরুদ্দীন জঙ্গি ‘বায়তুল মাকদিস’ স্বাধীন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টার ফল দৃশ্যমান হয় সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর সময়ে। ৫৮৩ হিজরিতে তিনি ‘বায়তুল মাকদিস’ খৃস্টান শক্তির দখল থেকে মুক্ত করে মুসলমানদের হাতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। পবিত্র নগরীতে অত্যাচার ও নির্যাতনের অবসান হয় এবং ইসলামের সূর্য পূর্ণ তেজ ও আলো নিয়ে উদ্ভাসিত হয়। খৃস্টানরা জেরুসালেম নগরী দখলের পর সেখানে অত্যাচার ও বর্বরতার নজির স্থাপন করেছিল। পক্ষান্তরে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী সেখানে সাম্য ও ন্যায়বিচারের এমন আদর্শ উপস্থাপন করেন যা খৃস্টান ঐতিহাসিকরাও স্বীকার না করে পারেননি। বিশেষ করে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক লেনপোল তা অকপটে স্বীকার করেছেন।
৬৫৬ হিজরিতে তাতারীরা বাগদাদ ধ্বংস করে। তারা ইরাক ধ্বংস করার পর সিরিয়ার দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু ৬৮৫ হিজরিতে আইনজালুতে তারা জাহির বাবিরাসের কাছে পরাজিত হয়। তারপর ইরাক ধ্বংসকারী এই তাতারীরা একজন নিষ্ঠাবান মুসলমানের দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণ করে।

খৃস্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের ধারাবাহিকতা শুরু হয়। ইউরোপ, বিশেষ করে বৃটেন ও ফ্রান্সসহ প্রাচ্যের দেশগুলোতে উপনিবেশ স্থাপন করে। নিজেদের শাসন ও কর্তৃত্ব স্থায়ী করার জন্য তারা স্থানীয় জনগণের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। তবুও মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত রাখা যায়নি। মুসলিম মুজাহিদরা দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে অকাতরে জান মাল উৎসর্গ করেন। হাজার হাজার প্রাণ ও যথাসর্বস্ব নিঃশেষ করার বিনিময়ে মুসলমানরা গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্তি লাভ করেন। দখলদার ও ঔপনিবেশিক শক্তিকে বিতাড়িত করার সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে দাগেস্তানে সাইয়েদ শামিল, আলজেরিয়ায় আব্দুল কাদের জাযায়েরি, আফ্রিকায় আমির আব্দুল করীম খাত্তাবি, লিবিয়ায় শায়েখ সান্নুসী ও ভারত উপমহাদেশে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের সংগ্রাম-সাধনা কীর্তি ও অবদান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী ও নূরুদ্দীন জঙ্গির ত্যাগ ও নিরন্তর সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।

ইসলামী দেশগুলো থেকে বিদেশী দখলদারিত্বের অবসান হয়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এইসব স্বাধীন দেশের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য নতুন কৌশল ও পদ্ধতি বেছে নেয়। সমরাঙ্গনে বার বার পরাজয়ের পর তারা মুসলিম দেশগুলোকে তাবেদার করে রাখার জন্য পরোক্ষ ও নীরব যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে। সেই নীরব যুদ্ধ শিক্ষার যুদ্ধ। এ প্রসঙ্গে এক পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীর কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, এসব পরাজয় ও বার বার ব্যর্থতা থেকে বাঁচবার পথ এই যে ইসলামী দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার আদলে সাজাতে হবে। পরিত্রাণের এটাই একমাত্র উপায়। এই উপায়ে ইসলামী বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ও ধর্মগুরুদের ওপর কী প্রভাব পড়ে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

এজন্য তারা ইসলামী সংস্কৃতির ওপর হামলা চালায়। শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করে। পাঠ্যক্রম নিজেদের মতো করে সাজায়। ঐতিহ্যগুলো মুছে ফেলে। ইতিহাসের গ্রন্থগুলো নতুনভাবে বিন্যস্ত করে। শরয়ী আইনসমূহের ওপর আস্থা নষ্ট ও আরবি ভাষা বিলুপ্ত করার চেষ্টা চালায়। ইসলামী নামগুলো পর্যন্ত পরিবর্তন করে এবং ফরজ ইবাদতগুলো পালনের বিধিনিষেধ আরোপ করে। তাছাড়া তাদের প্রচার মাধ্যম, প্রশাসন, গোয়েন্দাসংস্থা, গোপন অনুসন্ধানী দল সবই পুরোপুরি লিপ্ত থাকে ইসলামের স্বকীয়তা বিকৃত করার কাজে। তবুও সভ্যতা, শিক্ষা ও কার্যকারিতার কারণে ইসলাম এখনো পুরো ইউরোপ আমেরিকার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। সামরিক প্রাধান্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি ও প্রতারণামূলক রাজনীতি-কূটনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও ইসলামের সততা, শ্রেষ্ঠত্ব ও সর্বজনীন শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অসহায়ত্ববোধ করছে ইউরোপ আমেরিকা । এজন্যই শত বিরোধিতা ও বিধিনিষেধ সত্ত্বেও পাশ্চাত্যে ইসলামগ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এখন ইসলামী বুদ্ধিজীবী ও মনীষী জন্ম নিচ্ছেন। যারা ঈমানের দৃঢ়তা, ধর্মীয় চেতনা ও গর্ববোধ এবং ইসলামের স্বার্থে জানমাল উৎসর্গ করার দিক দিয়ে তাদের চেয়ে মোটেই পিছিয়ে থাকেন না, যারা ইসলাম পেয়েছেন উত্তারাধিকার সূত্রে এবং লালিত পালিত হয়েছেন কুফুরি ও ইসলামবিরোধি পরিবেশ থেকে অনেক দূরে। ইউরোপ ও আমেরিকায় তারাই ইসলামের পতাকা সমুন্নত রেখেছেন যাদের মধ্যে ইসলামী দাওয়াতের প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে পাশ্চাত্য জগতে অবস্থানের সময়ে। এটাকে ইসলামের অন্যতম মুজিযা ছাড়া আর কী বলা যায়?

ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যখন প্রাচ্যের দেশগুলোতে শাসন চালিয়েছে, তখন ইসলামের বিলোপ সাধনে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তারা তাদের মিশনারি তৎপরতা ও উপকরণ কাজে লাগিয়ে মুসলিম উম্মাহর অসংখ্য তরুণকে প্রভাবিত করেছে। তারা এমন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি ও চালু করেছে, যাতে মুসলমানদের ইসলামী স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য বিলীন হয়ে যায়। যারা আকার-অবয়ব ও রক্ত-মাংসে মুসলমান হলেও মনোবৃত্তি, আচরণ ও অভিরুচিতে ইউরোপীয়। ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনকালে এখানকার জন্য নতুন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে একথাই বলেছিলেন লর্ড ম্যাকালে। ইংরেজদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী নিশ্চয়ই একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। যারা নিজেদের দেশ ও জাতির স্বার্থের চেয়ে দখলদার শক্তির স্বার্থ রক্ষায় স্বাচ্ছন্দবোধ করে। কিন্তু স্বয়ং ইউরোপ ও আমেরিকায় হয়েছে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। সেখানকার নতুন প্রজন্ম দৃশ্যত পশ্চিমা বংশোদ্ভুত। কিন্তু তাদের অন্তর ইসলামের ভালোবাসায় ভরপুর এবং তাদের মস্তিষ্ক ইসলামী ভাবধারা ও চিন্তায় উজ্জীবিত। ইউরোপ আমেরিকার অনেক এলাকায় আগে হয়ত কোনো মসজিদই ছিল না। কিংবা মাত্র একটি মসজিদ ছিল। এখন সেখানে অনেক মসজিদ। ইসলামী সেন্টার, ইসলামী লাইব্রেরি ও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। আর এ ধারা দিন দিন আরও বেগবান হচ্ছে। তাছাড়া প্রচার মাধ্যম ও সংবাদ সাময়িকীগুলোতে এ মর্মে লাগাতার সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে যে, সেখানকার শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর বাড়ছে এবং এক সময়ে যারা ইসলামের বিরোধিতা করেছিল তারা এখন ইসলামগ্রহণ করে নিজেদের ধন্য মনে করছে।

মোটকথা পাশ্চাত্য শাসকশ্রেণির ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলার মেহেরবানিতে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে এবং মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততা, ইসলামের স্বার্থে ত্যাগের প্রেরণা ও পাশ্চাত্য দর্শনের অসারতা সম্পর্কে অবগতি বাড়ছে। যেমন ২০১০ সালের এপ্রিলে ভ্যাটিকানের বরাতে একটি সংবাদ ছাপা হয় কুয়েতের আল মুজতামা ম্যাগাজিনে। এতে বলা হয় বিশ্বে সবচেয়ে প্রসার ঘটছে ইসলাম ধর্মের। ইসলামের বিরুদ্ধে নানামুখী তৎপরতা সত্ত্বেও এক বছরে খৃস্টানদের তুলনায় মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে তিরিশ লাখ। ফলে সারা বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে একশ তিরিশ কোটি বাইশ হাজার যা সারাবিশ্বে খৃস্টানদের জনগোষ্ঠীর তুলনায় তিরিশ লাখ বেশি। বর্তমানে বিশ্বের মোট জন সংখ্যার শতকরা উনিশ ভাগ মুসলমান। অথচ খৃস্টান সতের ভাগ। ইসলাম গ্রহণকারীদের বেশিরভাগই পাশ্চাত্যের ইহুদি, খৃস্টান ও অন্যান্য ধর্মের লোক।

মুসলমানদের সর্বশেষ প্রধান সাম্রাজ্য ছিল তুরস্কের উসমানি সালতানাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানি সালতানাত ছোট ছোট টুকরায় বিভক্ত করা হয় এবং আরব ও তুর্কিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও স্বাদেশিকতার বিষ সংক্রমিত করা হয়। ফলে তুরস্ক থেকে আরবরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আরব এলাকাগুলো ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দখলে চলে যায়। তারা আরব বিশ্বকে ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। এভাবে তুরস্কের উসমানি খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে মুসলিমবিশ্ব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং মুসলমানদের ঐক্যের সূত্র টুকরো টুকরো হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে মোহান্ধ আরবরা আবার পরস্পরে বিভেদে জড়ায় এবং আরববিশ্ব পরিণত হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে। গোটা আরব ভূখ- ও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র সম্পূর্ণরূপে বদলে যায়। এসবই সাম্রাজ্যবাদীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের ফসল। এই চক্রান্ত এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মিসর ও ফিলিস্তিনে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং যেমন ঘটনা প্রবাহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রচ্ছদ দখল করে রেখেছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মধ্যপ্রা”্যরে মানচিত্র আবার পরিবর্তনের লক্ষ্যেই এগুলো করা হচ্ছে বলে আর্ন্তজাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছিলেন, তার উদ্দেশ্য ইসলামী ও আরব বিশ্বে ছোট ছোট রাজ্য গঠন করা এবং আরববিশ্বের মানচিত্র নতুনভাবে বিন্যস্ত করা।

আসলে তুর্কিরা ছিল একটি সামরিক ও যোদ্ধা জাতি। এজন্য তারা তাদের সালতানাতের আয়তন সম্প্রসারণে সফল হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু শিক্ষা সংস্কৃতির দিকে তারা মনোযোগ দেয়নি। বরং তারা পশ্চিমাশিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করে। পশ্চিমা দেশগুলো উসমানি খেলাফতের অধীনস্থ দেশগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিশনারী সংস্থা চালু করে। এতে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা ও ভাবধারায় পরিপুষ্ট একটি উল্লেখযোগ্য শ্রেণি গড়ে ওঠে। উসমানি সালতানাত বিলোপের পিছনে এই শ্রেণিটি মৌলিক ভূমিকা পালন করে।

অবশ্য তুর্কি জাতির ঘোর কাটতে বেশি দিন লাগেনি। আধুনিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে তুরস্কের শত শত বছরের গৌরব ও ঐতিহ্য নিশ্চিহ্ন করার হীন প্রয়াস তুর্কি জাতি অচিরেই টের পায়। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম ও সাধনা। শত অত্যাচার ও নির্মম দমনাভিযান সত্ত্বেও তুর্কি জাতির ইসলামী পরিচয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেমে যায়নি। ছয় দশকের আন্দোলনের ফল দৃশ্যমান হতে থাকে গত শতাব্দির আশির দশক থেকে। বর্তমান ক্ষমতাসীন জাস্টিজ অ্যা- ডেভলপমেন্ট পার্টি বা একেপির সরকার তুর্কিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফসল। শাসনতান্ত্রিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় এলেও এবং দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি শক্তিশালী করলেও একেপি সরকারকে সহ্য করা পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য কঠিনই রয়ে গেছে। তাই একের পর এক ষড়যন্ত্র হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়েব এরদোগানের সরকারকে উৎখাত করার জন্য।

কোনো ইসলামী রাষ্ট্র শত্রুর দখলে চলে যাওয়া কিংবা রনাঙ্গণে মুসলিমবাহিনীর পরাজিত হওয়া সাময়িক ব্যাপার। ইসলামের ইতিহাসে এমন ঘটনা বার বার ঘটেছে। কিন্তু পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয় জনগণের মন মস্তিষ্ক ও আবেগ অনুভূতি। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইউরোপ এই বাস্তবতা ভালোভাবে বুঝেছিল। এজন্য তারা সামরিক অভিযানের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের কৌশল অবলম্বন করেছিল। এতে তারা কিছুটা সফলও হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর থেকে এতদিন এই নীতিই পোষণ করে এসেছে ইউরোপ। কিন্তু ইদানিংকালের ঘটনাবলী থেকে অনুমান করা যায় পাশ্চাত্য আবার খোলাখুলি সাম্রাজ্যবাদের নীতি অবলম্বন করেছে। সেজন্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সরাসরি সামরিক আগ্রাসনে দ্বিধাবোধ করছে না। আফগানিস্তান, ইরাক, মালি, মিসর, সিরিয়া, তিউনিস, ইয়ামেন, মধ্য আফ্রিকা, সুদান, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জোর তৎপরতা চলছে।

মুসলিম উম্মাহর বর্তমান পরিস্থিতি বিগত দিনের পরিস্থিতি থেকে ভিন্ন। অতীতে তাদের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে সীমিত পর্যায়ে ও অঞ্চল ভিত্তিতে। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম উম্মাহকে অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সব দেশে। অথচ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বেশির ভাগ দেশেই মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলমানদের সামনে রয়েছে বিভিন্নমুখী সমস্যা ও পরীক্ষা। আবার এসব পরীক্ষা সেই মুসলমানদের তৈরি করা, যারা তাদের ভাই। অর্থ্যাৎ তারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমানদের ভাই ও স্বজন। কিন্তু বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও সংস্কৃতিতে তারা মুসলমানদের বরং খাঁটি মুসলমানদের দুশমন। তাই মুসলমানদের এখন বাহিরের হামলা নয়, অভ্যন্তরীণ হামলার শিকার হতে হচ্ছে। প্রশাসন, প্রতিরক্ষা বিভাগ, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিভাগ, বিচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, গণমাধ্যম মোটকথা জনজীবনের সব বিভাগেই এমন ব্যক্তিবর্গ অধিষ্ঠিত রয়েছে যাদের মন মস্তিষ্ক ও চিন্তা চেতনায় ইসলামের প্রতি শত্রুতায় পরিপূর্ণ এবং তারা পশ্চিমাদের ইঙ্গিত ও পরামর্শে সব কাজ করেন।

যেমন ‘চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ’ পরিভাষা দুটি পশ্চিমাদের তৈরি। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শিষ্যদেরকে তা শিখিয়েছেন। এজন্য মুসলিম বিশ্বের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক শ্রেণি চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ, স্বাধীনতা ইত্যাদি পরিভাষার নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা করতে পারে না। কেননা তারা না বুঝেই তা গ্রহণ করেছেন এবং অন্যায়ভাবে তা প্রয়োগ করেছেন দীনদার মুসলমান ও ইসলাম প্রচারকদের ওপর। অথচ বাস্তবতা এই যে, ইসলামী জাগরণ দমনের জন্য যে নির্মম ও মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হয় তা একেবারেই চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ। তবে কোথাও কোথাও ইসলামপন্থীদের মাঝে যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা যায় তা তাদের প্রতি দমন ও নিপীড়নমূলক আচরণের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। ইসলামের প্রসার ও ধর্মীয় চেতনা লালনকারীদের প্রতি মুসলিম দেশগুলোতে শুধু বৈষম্য নয় বরং চরম অবিচারের আচরণ করা হয়। এমনকি কোনো ইসলামী বুদ্ধিজীবী বা সংগঠন পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতি ও দর্শনের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করলেও তাকে বা তাদেরকে সন্ত্রাসবাদী নাম দেয়া হয় এবং এই অজুহাতে দমন অভিযান চালানো হয়।

মোটকথা ইসলামের লালন, পালন ও প্রসারে যে বা যারা যতই নিষ্ঠাবান ও নিবেদিত প্রাণ, সে বা তারাই পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে ততই বিপদজনক। তাই তাকে বা তাদেরকে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে প্রচারণা চালায় পশ্চিমামিডিয়া। আর পাশ্চাত্যের ভাবধারা ও দর্শনে দীক্ষাপ্রাপ্ত মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণি এতে মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে।

এটি নতুন বিপদ। নতুন সমস্যা। নতুন ফিতনা। ইসলামী ইতিহাসে এই ফিতনার নজির নেই। এখন কোনো উত্তেজনা নয়, অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে ও গভীর অভিনিবেশ সহকারে সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিভঙ্গি ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে এই ফিতনা প্রতিরোধের উপায় অনুসন্ধান করতে হবে। মুসলিম উম্মাহর সামনে এটাই বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আলেম সমাজের ও মুসলিম বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এটাই বড় কর্তব্য। ইসলামের দাওয়াতী কাজে যারা নিয়োজিত আছেন, ইসলামের সার্বিক বাস্তবায়ন যারা কামনা করেন এবং ইসলামকে আখেরি দীন হিসেবে যারা বিশ্বাস করেন তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মুসলিম উম্মাহর সমস্যা সমাধানের জন্য উন্নত থেকে উন্নতর পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। ইসলামকে প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞতার সাথে উপস্থাপন করে আধুনিক সমস্যাবলীর সমাধান করতে হবে। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, ঐক্য ও সমঝোতা থাকতে হবে। মুসলমানদের দীনী পরিচয় ও ধর্মীয় স্বকীয়তা রক্ষার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। মুসলিম দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থায় যতদিন ইসলামী দীক্ষার কার্যকর পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত হবে না এবং শিক্ষাব্যবস্থায় খাঁটি ইসলামী বিশেষজ্ঞ শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে না, ততদিন মুসলিম বিশ্বের পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে না। এজন্য পাশ্চাত্যের নিরন্তর চেষ্টা ও তৎপরতা থাকে মুসলিম দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা এমন শ্রেণির হাতে রাখতে যারা পাশ্চাত্যের অনুগত ও বিশ্বস্ত এবং পাশ্চাত্যের স্বার্থ রক্ষায় আন্তরিক। এই পরিস্থিতি সংস্কারে প্রয়োজন যোগ্য জনবল তৈরি করা এবং অভ্যন্তরীণ পর্যায়েও জনসাধারণের মধ্যে পরিবর্তন সূচিত করা। মুসলিম দেশগুলোর বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের কর্তব্য মুসলিম উম্মাহর এই নতুন ফিতনা অনুধাবন করা এবং এই ফিতনা প্রতিরোধে ভৌগোলিক ও গোষ্ঠীগত সীমানা থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামী উম্মাহর সীমানায় অবস্থান করে চিন্তা করা। নইলে এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে, মুসলিম দেশগুলোর ভৌগোলিক স্বাধীনতাও অক্ষুণœ থাকবে না।

ইতিহাস সাক্ষী, মুসলিম উম্মাহ যখন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি, ঈমান ও ইয়াকিন সহকারে এবং পাপাচার বর্জন ও আত্মসমালোচনার সঙ্গে বিপদাপদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ সামাল দিয়েছে, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের সাহায্য করেছেন এবং তারা বিজয়ী হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের একটি পর্বে রয়েছে মুসলমানদের গৌরবময় বিজয়, বিশাল বিস্তৃত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, অপরাজেয় সামরিক শক্তির অধিকারী হওয়া, বিশ্ববাসীকে অনুপম সভ্যতা ও সংস্কৃতি উপহার দেয়া এবং বিশ্বে নিজেদেরকে সবচেয়ে উন্নত জনগোষ্ঠী হিসেবে প্রমাণিত করা। দ্বিতীয় পর্ব মুসলমানদের পরীক্ষার ইতিহাস। মুসলিম উম্মাহকে অত্যন্ত কঠিন যুগ পার করতে হয়েছে। দীর্ঘকাল চরম নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। বর্তমানেও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন সূচিত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকতে পারে।

লেখক
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সিনিয়র মুহাদ্দিস
জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া ঢাকা