ইসলামের আলোকে স্বাধীনতা

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী

নীলাকাশে পাখী যেমন স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়, মানুষেরও ইচ্ছে স্বাধীনভাবে বাস করবে। ইসলাম মানুষের এই স্বাধীনতায় বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করেনি। মানুষকে কথা বলার স্বাধীনতা ইসলাম দান করেছে, চিন্তা করার স্বাধীনতা দান করেছে, বুদ্ধির স্বাধীনতা দান করেছে। তবে সব স্বাধীনতার একটি সীমারেখাও নির্ধারণ করা হয়েছে। আমি কথা বলতে পারব, আমার ইচ্ছামত ভাল কথাগুলো আমি বলতে পারব। যে কোন পেশা আমি গ্রহণ করতে পারব। ইসলাম আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, আমি ব্যবসা করতে চাইলে যে কোন হালাল ব্যবসা করতে পারব, চাকুরী করতে চাইলে ভাল চাকুরী করতে পারব, চাষ করতে চাইলে চাষ করতে পারব। ইসলাম আমাকে জোর করে সুনির্দিষ্ট কোন পেশা গ্রহণ করতে হবে বলে চাপ সৃষ্টি করেনি। কুরআনের কোন জায়গায় বলা হয়নি যে, আমি এক আল্লাহকেআমাকে মানতেই হবে তুমি বুঝ বা না বুঝ।

ইসলাম বলেছে- “যার ইচ্ছা ঈমান আন আর যার ইচ্ছা কুফরী কর।” (কাহাফ-২৯) আমি সবকিছু তোমাদের সামনে বর্ণনা করেছি, সব যুক্তি তুলে ধরেছি। এর পরে চিন্তা ভাবনা করে ইসলাম গ্রহণ করলে কর আর না করলে না কর। আল্লাহতায়ালা চাপ সৃষ্টি করেনি, তাকে ইসলাম গ্রহণ করতেই হবে বলেনি। চিন্তা করার স্বাধীনতা ইসলাম মানুষকে দান করেছে ইসলাম মানুষকে খাওয়া ও পান করার স্বাধীনতা দিয়ে বলেছে, খাও এবং পান কর তবে অপচয় করোনা। (আল আ’রাফ-৩১) ইসলাম কাউকে সান্ন্যসী ধর্ম গ্রহণ করতে বলেনি, ইসলাম একের অধিক বিয়ে করারও স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম বলে-মেয়েদের মধ্যে যাকে পছন্দ তাকে বিয়ে কর। (নিসা-৩) ইসলাম শুধু কাদঁতে বলেনি, ইসলাম বলে, হাসবে আনন্দ করবে তবে অতিরিক্ত নয়। (তাওবা-৮২) ইসলাম শুধু জাগ্রত থাকতে বলেনি, ইসলাম বলে, আমিতো ঘুমকে মানুষের জন্যে আরামদায়ক করেছি। (নাবা-৯) ইসলাম পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ধর্ম। ইসলাম পূর্বে মানুষকে পরাধীন করে রাখা হত। রাজা প্রজাদের উপর, শাষকরা শাষিতের উপর নির্যাতন করত। মুসলমানদের একজন সেনাপতি পারস্যের সেনা প্রধান রুস্তুমের কাছে যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেল, তিনি বললেন, পারস্য জাতি সারা পৃথিবী পরিচালনা করে, আর রোম জাতি পৃথিবীর বিশাল এক শক্তি, আমরা তো জানতাম না যে, অন্য কোন জাতি নেতৃত্ব দিতে পারে, পৃথিবীতে দুটি সাম্রাজ্য আছে, একটি হচ্ছে পারস্য, আরেকটি রোম। তোমরা কারা? সুদূর আরব থেকে তোমরা কারা বের হলে, তোমাদের পরিচয় কি? তোমাদের মিশন কি? মুসলমানদের সেনাপতি ছিলেন ‘রিব্য়ী ইবনে আমের’। তখন মুসলমানদের পরিচিতি তুলে ধরে মুসলমান সেনাপতি বললেন, আমরা আরবের কোন জাতি নই, আমরা আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত একটি জাতি। আল্লাহই আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আমাদের মিশন, মানুষ যাতে প্রকৃত স্বাধীনতা ফিওে পায়। মানুষ মানুষের উপর যাতে রাজত্ব করতে না পারে, একে অপরকে যেন গোলাম বানাতে না পারে। মানুষকে গোলামীর জিঞ্জির থেকে স্বাধীন করে একমাত্র আল্লাহর গোলামী করা, মানুষকে আল্লাহর অধীন করাই হচ্ছে আমাদের মিশন। কাজেই মুসলমানদের মিশন হল, মানুষ মানুষের গোলামী করবে না, মানুষ মানুষের দাসত্বে আবদ্ধ হবে না, মানুষ একমাত্র দাসত্ব করবে আল্লাহর। এটাই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা ও প্রকৃত স্বাধীনতা। রোম জাতির রাজারা প্রজাদেরকে গোলাম মনে করত, মিশরের ফেরআউন জনগণকে মনে করত দাস, প্রাচীন জাতিগুলোতে মানুষ মানুষের স্বাধীনতা হনন করত। একে অপরকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে রাখত।

ইসলাম স্বাধীনতার পক্ষে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি, চিন্তার স্বাধীনতা, বক্তব্যের স্বাধীনতা ইসলাম সমর্থন করে। হযরত ওমর যখন খলীফা নির্বাচিত হন, তখন বলেন- হে মানব সকল, আমি ওমর তোমাদের মত রক্ত মাংসের একজন মানুষ, তোমাদের উপর আমার পৃথক কোন মর্যাদা নেই, আমি খলীফা তোমাদের প্রধান বলে পৃথক কোন মর্যাদা নেই, আমি তোমাদের মতই মানুষ। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমি ওমর যদি হক্ব পথে চলি, তাহলে আমাকে সমর্থন করবে, সহযোগিতা করবে। আর আমি ওমর যদি কোন অন্যায় করি, কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন কাজ করি, তাহলে সাথে সাথে তোমরা আমাকে শুধরে দেবে। জনগণকে সমালোচনা করার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা খলীফারা মুসলমানদেরকে দান করেছেন। তখনি এক গ্রাম্যলোক তরবারী নিয়ে হযরত ওমরের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন, আর বললেন হে ওমর, তুমি যদি আল¬াহ এবং আল্লাহর রাসুলের কথা মত চল তবে তোমাকে আমরা সমর্থন করব, সহযোগিতা করব। একজন মহান খলীফা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেয়াকালীন সামান্য একজন গ্রাম্য মানুষকে খলীফার বিরুদ্ধে তরবারী নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা ইসলাম দিয়েছে। ওমর পুলিশ বাহিনীকে বলেননি যে, এই বেয়াদবকে সায়েস্তা করে দাও। সে সকলের সামনে আমাকে লজ্জিত করেছে। সবার সামনে বেয়াদবী করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এভাবে প্রকাশ্যে বলা হয় না, গোপনে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, একে শায়েস্তা কর, পথে পথে নির্যাতন কর, সমূল্যে উৎখাত কর। অথচ এমন নিষ্ঠুর নির্দেশ হযরত ওমর দেননি। অথচ এই হযরত ওমরকে দেখলে মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে যেত। একবার রাস্তা দিয়ে ওমর রা. যাচ্ছেন, হঠাৎ তিনি পিছনের দিকে তাকালেন, তাকে পিছনে তাকাতে দেখে পিছনের কয়েকজন লোক ভয়ে চিৎ হয়ে পড়ে যায়, তিনিই হচ্ছে হযরত ওমর। সেই ওমরকে একজন গ্রাম্য লোক তরবারী উঁচিয়ে সংশোধন করার প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করছে, এটাই হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতা।

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে একটি সূরা নাযিল করেছের্ন, সূরাটির নাম হল। ‘শুয়ারা’। কবি, সাহিত্যিককেই শুয়ারা বলা হয়। সেই সূরার মধ্যে আল্লাহ বলেছেন- যারা (বুদ্ধিজীবী) কবি তারা বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে, সুন্দর কথা তাদের মুখ-কলম দিয়ে বের হয়, কিন্তু কাজে তা প্রয়োগ হয়না। (শুয়ারা-২২৪) আমাদের দেশে অনেক বুদ্ধিজীবীর কলম দ্বারা জাতি উপকৃত হয়। জাতি তাদের বুদ্ধির আলোকে আলোকিত হয়। আবার এমন কিছু লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী দেশে আছে, যাদের কলম দিয়ে জ্ঞানের পরিবর্তে এমন বর্জ্য বের হয়।

যারা পত্র-পত্রিকায় লিখে ইসলাম নারীকে ঠকিয়েছে, যারা আজ নারী স্বাধীনতার কথা বলে স্লোগান দেয়, তারাই নারীদের ইজ্জত লুন্ঠন করে। আর নারী স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে নারীদেরকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করে । স্বাধীনতার নামে নোংরামী আর ময়লা আবর্জনা মানুষকে গিলানোর ক্ষমতা ইসলাম কোন বুদ্ধিজীবী বা পন্ডিতকে দেয়নি। ধর্ম বিদ্বেষী নাস্তিক ও কমিউনিস্ট কতৃক স্বাধীনতার নামে দেশের সমাজের যুবকদের বিভ্রান্ত করা, রাষ্ট্রকে কলংকিত করা, মুসলমানদের ঈমানে সমানতালে আঘাত করা এমন স্বাধীনতাকেইসলাম সাপোর্ট করেনা। বরং ইসলাম কিছু সংবিধানের আওতায় পুরুষের চেয়ে নারীকে

সম্মান আরো বেশি দিয়েছে। ইসলাম লেখককে দিয়েছে লেখার স্বাধীনতা, বক্তাকে দিয়েছে বলার স্বাধীনতা, বুদ্ধিজীবীকে দিয়েছে চিন্তা-বুদ্ধির স্বাধীনতা। তাই আসুন, লক্ষ শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় এই স্বাধীনতার মাসে প্রকৃত স্বাধীনতার অবস্থা অনুধাবন করি। সবাই মিলে একটি প্রকৃত স্বাধীন সুন্দর ও শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ি।