ইসলামী বিপ্লব : পথ ও পদ্ধতি

শেখ মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ইসলামী বিপ্লবের উপাদান
একটি বিপ্লবী আন্দোলন সফল করার জন্য একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট সমাজের বাস্তত অবস্থা, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির আনুকূল্য প্রয়োজন, ঠিক তেমনি বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ও উপকরনের পর্যাপ্ত উপস্থিতি প্রয়োজন।
ইসলামী বিপ্লব একটি আদর্শিক বিপ্লব। তাই আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কর্মী বাহিনী, নেতৃত্ব ও জনসমর্থনের ওপর বিপ্লব নির্ভর করে। তাই এগুলো বিপ্লবের মৌলিক উপাদান ও মূল নিয়ামক।

নেতৃত্ব
ইসলামী বিপ্লবের প্রধান উপাদান হচ্ছে ইসলামী আদর্শের আলোকে গড়া নেতৃত্ব। ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্ব সমাজ গঠনের প্রধান উপাদান সমাজ বিপ্লবের জন্য মৌলিক ভাবে চাই সমাজের নেতৃত্ব। সমাজে প্রতিনিধিত্বশীল যোগ্য ব্যাক্তিত্ব ও নেতৃত্ব তৈরী না হলে সমাজবিপ্লব বাস্তবরুপ পেতে পারে না।

অতএব, সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা আন্দোলন বা সংগঠনের মৌলিক কাজ হবে সমাজ নেতৃত্বের চাহিদা পূর্ণ করা। সংগঠন নেতৃত্ব তৈরীর ধারাবাহিকতায় কারখানার ভূমিকা পালন করবে। সমাজের সচেতন অংশের মধ্য থেকে মৌলিক মানণীয় গুণাবলী সম্পন্ন লোকদেরকে যথার্থ প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে তৈরী করতে হবে। একদিকে আন্দোলনে শরীক লোকদের যোগ্যতা অর্জনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস সাধনা করতে হবে। অপরদিকে সমাজের সচেতন সক্রিয় ও মৌলিক মানণীয় গুণাবলী সম্পন্ন লোকদেরকে আন্দোলনের শরীক করার চেষ্টা চালাতে হবে।

কর্মী বাহিনী
কর্মী বাহিনী হলো একটি আন্দোলনের প্রাণশক্তি। বিপ্লবী সংগঠনে একজন কর্মীর ভূমিকা মানুষের মেরুদণ্ডের ন্যায়। মেরুদন্ডের দূর্বলতা নিয়ে একজন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না তেমনি কর্মী বাহিনীর দূর্বলতার কারণে সংগঠন বিপ্লব তো দূরের কথা অস্তিত্বও ধরে রাখতে পারবে না। কর্মীদের দৃঢ়তা, সক্রিয়তা ও কর্মদক্ষতায় সংগঠন সম্প্রসারণ ও মজবুত হয়। কর্মীরাই জনগণকে বিপ্লবের ¯^প্ন দেখায়। কর্মীদের সামগ্রিম কর্মতৎপরতায় জনগন সংগঠনের প্রতি আস্থাশীল হয়। কর্মীদের মধ্যে থেকেই সংগঠনের নেতৃত্ব তৈরী হয়।

জনসমর্থন
ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম উপাদান হচ্ছে বিপ্লবের পক্ষে জনমত সৃষ্টি। কেননা ইসলামী বিপ্লব হচ্ছে সমাজের সার্বিক পরিবর্তন। আর সমাজ হচ্ছে জনগণের সমš^য়ে গঠিত। সুতরাং সমাজের পরিবর্তন মানে প্রথমত জনগণেরই পরিবর্তন। সমাজের মানুষই যদি পরিবর্তন না চায় বা পরিবর্তনকে রোধ করতে সচেষ্ট হয় তাহলে সমাজ পরিবর্তন বিশেষ করে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন অসম্ভব। কাজেই বলা যায়, সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সখা ও জনমতের সম্পর্ক জনগণ পরিবর্তন না চাইলে আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে- “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষন না সে জাতি নিজেই নিজের অবস্থার পরিবর্তন করে” (সূরা রা’দ-১১)

সুতরাং সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন জনগণের মর্ধে পরিবর্তন। জনগণ না চাইলে কোন পরিবর্তন জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না। রাসূল সা. এর দাওয়াতী জীবনের প্রথমে মক্কায় লোকেরা ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেনি। মক্কায় ইসলামের অনুকূলে জনমত তৈরী হয়নি। ফলে ইসলাম প্রথমে মক্কায় কায়েম হয়নি। মদীনায় ইসলামের অনুকূলে জনমত তৈরী হয়েছে বিধায় মদীনায় ইসলাম কায়েম হয়েছে। সুতরাং বুঝা গেল যে, দীন কায়েমের জন্য সংশ্লিষ্ট জাতির জনমত অনুকূলে থাকা প্রয়োজন। ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থায় খলিফার হাতে জনসাধারণের বাইয়াতের দ্বারা তার প্রতি জনসমর্থন আদায় উদ্দেশ্য। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামী বিপ্লবের জন্য কতটুকু জনমত জরুরী?

কুরআন অধ্যয়নের দ্বারা বুঝা যায় যে, বিপ্লবের জন্য এক-তৃতীয়াংশ জনমত জরুরী। সূরা আনফালের ৬৬ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যদি দৃঢ়চিত্ত একশ লোক বিদ্যমান থাকে, তবে জয়ী হবে দু’শর মোকাবেলায়। আর যদি তোমরা এক হাজার হও তবে আল্লাহর হুকুমে জয়ী হবে দু’হাজারের ওপর। আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” এ আয়াতের বিরোধী পক্ষের মোকাবেলায় এক-তৃতীয়াংশ শক্তি সঞ্চয়ের কথা বলা হয়েছে।
মূলত : এক-দশমাংশ হলো বিজয়ের সর্বোচ্চ মান। অর্থাৎ মুমিনরা যদি কাম্য মানের ধৈর্য্যরে অধিকারী হয়, নৈতিক যোগ্যতাও কাম্যমানের হয় এবং দৃঢ়তার সাথে বিরোধী পক্ষের মুকাবেলা করতে পারে তাহলে এক-দশমাংশ শক্তি নিয়েই বিজয় লাভ করা সম্ভব। আর এক-তৃতীয়াংশ এলো সর্ব নিম্ন মান। বিজয়ের জন্য তা সংগ্রহ করতেই হবে।

ইসলামী বিপ্লব ও সংগঠন
সংগঠন হলো বিপ্লবের বাহন, সংগঠন ছাড়া বিপ্লব সাধন করা সম্ভব নয়। ওমর রা. বলেন : “সংগঠন ছাড়া ইসলামী প্রতিষ্টা লাভ করতে পারেন।” সংগঠন বিপ্লবের মৌলিক উপাদান তথা নেতৃত্ব, কর্মী বাহিনী ও জনসমার্থন তৈরী করে। সংগঠনই আন্দোল সংগ্রাম পারিচালনা সংগঠন যেহেতু বিপ্লবের বাহন অতএব বিপ্লব করে সংগঠিত হবে তা নির্ভর করে সংগঠনের গতির ওপর। সংগঠন যত দ্রুতগতি সম্পন্ন হবে ততদ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে। অপরদিকে বাহন যত মজবুত ও শক্তিশালী হয়ে সে তত বেশী ভার বহন করতে পারে। তেমনি সংগঠন যত মজবুত ও শক্তিশালী হবে আন্দোলন সংগ্রাম ও বিপ্লবের ভার তত বহন করতে পারবে। তবে মনে রাখতে হবে, একটি বিপ্লবী সংগঠক একদিনেই মজবুত হবে না বরং তা একটি ¯^াভাবিক পথ ধরে ক্রম বিকশিত হয়। এই ক্রমবিকাশের জন্য যেমন প্রয়োজন কর্মীদের নিরলস ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, তেমনি প্রয়োজন সময়ের কাক্সিখত মানের কর্মীবাহিনী গঠন ও জনগনের মন মানসিকতা তৈরীর জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। তড়িঘড়ি করে মানফিলে মাকসুদে পৌঁছা ইসলামী সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালঅ একটি উপমার মাধ্যমে ইসলামী সংগঠনের ক্রমবিকাশের চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তা এমন একটি বীজের ন্যায় যা অংকুর বের করলো, অতঃপর শক্তি সঞ্চয় করলো, তারপর মোটা- তাজা হলো এবং অবশেষে নিজ কান্ডের দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে গেল। (সূরা আলফাতহ-২৯)

এখানে সাহাবায়ে কেরামের সুমহান জামায়াতের ক্রমবিকাশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতে ক্রমবিকাশের চারটি পর্যায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা :
১. অংকুর বেরা করা
২. শক্তি অর্জন করা
৩. মোটা-তাজা হওয়া
৪. কান্ডের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া।

অংকুর বের করার অর্থ বিপ্লবের জন্য সংগ্রাম শুরু করা। চারা উদগত হওয়ার পর তা যেমন দূর্বল হয় তেমনি ইসলামী সংগঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে তা দূর্বল থাকে। চারাগাছ যেমন প্রতিকূল আবহাওয়ায় বেড়ে উঠে। ইসলামী সংগঠনও প্রতিকূলতার মাঝেই সামনে অগ্রসর হয়। এ প্রতিকূলতার মধ্যেই ইসলামী সংগঠন শক্তি সঞ্চয় করে। শক্তি অর্জন করার অর্থ সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করা। এখানে প্রথমে পাথমিক পর্যায়ে খুব অল্প সংখ্য মানুষই অংশগ্রহন করে। আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সমাজে আদর্শের পক্ষে একট স্রোত সৃষ্টি হয়। মোটা তাজা হওয়ার অর্থ গনভিত্তি অর্জন করা। সমাজে যখন আদর্শের পক্ষে স্রোত সৃষ্টি হবে তখন জনগণ দলে দলে সংগঠনের পতাকা তাহলো ঐক্যবদ্ধ হবে।

কাণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হলো সমাজ বিপ্লবের সাধিত হওয়া বিপ্লবী সংগঠনের কর্মী বাহিনীরকে সংগঠনের এই ¯^াভাবিক ক্রমবিকাশের কথা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। এখানে তড়িগড়ি কিছু করে ফেলার প্রবনতা বিপ্লবের জন্য ক্ষতি কারন হতে পারে।

লেখক
কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন

  • লেখাটি ইশা ছাত্র আন্দোলন-এর দ্বিমাসিক মুখপাত্র ‘ছাত্র সমাচার’ আগস্ট-সেপ্টেম্বর’১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।