“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূল সা. এর এবং তোমাদের মধ্যকার “উলিল আমর” তথা দলপতি বা আমীরের। আর যদি তোমরা পরস্পরে কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হও; তাহলে আল্লাহ ও রাসূলের নিকট তা প্রত্যার্পন করবে যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও আর তাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক থেকে উত্তম।” (সূরা নিসা-৫৯)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের নির্দেশ দেন অতপর তাঁর রাসূলের আনুগত্যের কথা বলে সর্বশেষ বলেন ‘উলিল আমর’ এর আনুগত্যের কথা।

উলিল আমর:

আভিধানিক অর্থে ঐ সকল ব্যাক্তিকে বলা হয় যাদের হাতে কোন বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে এ কারণেই হযরত ইবনে আব্বাস রা., মুজাহিদ ও হাসান বসরী রহ. প্রমুখ মুফাসসিরগণ আলেম ও ফক্বীহদেরকে ‘উলিল আমর’ সাব্যস্ত করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রা.সহ মুফাসসিরীনদের আরেকটি দল বলেছেন যে, যাদের হাতে দল বা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব থাকে তাদেরকে উলিল আমর বলা হয়। তাফসীরে ইবনে কাসীরে ‘শাসক, আলেম, দলপ্রধান’ কে উলিল আমর বলা হয়েছে। অতএব বোঝা গেল একজন মুসলিমের জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা ও রাসূল সা. এর আনুগত্য যেমন অপরিহার্য কর্তব্য ঠিক তেমনি আমীর বা দলপ্রধানের আনুগত্য করাও ওয়াজিব। কেননা ‘আমর’ বা নির্দেশসূচক শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা যে হুকুম করেন তা ওয়াজিব বোঝানোর জন্যেই হয়ে থাকে। উলে­খিত আয়াতে ‘আমর’ বা নির্দেশসূচক শব্দের মাধ্যমেই আল্লাহ তা’আলা উলিল আমরের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমীরের আনুগত্য করা ওয়াজিব বা অপরিহার্য কর্তব্য। উপর্যুক্ত আয়াতটি অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, আমীরের আনুগত্যের মাধ্যমে মুসলিম ও মুনাফিকের পরিচয় নির্ণিত হয়।

আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট:

বিশ্র নামক একজন মুনাফিকের সাথে এক ইহুদীর বিবাদ বেঁধে যায়। এক্ষেত্রে  ইহুদী লোকটি ছিল ন্যায়ের ওপর আর মুনাফিক ছিল প্রকৃত দোষি। তাই ইহুদী লোকটি সামাধানের জন্য রাসূল সা. এর দরবারে আসতেই প্রফুল­ বোধ করল। ইহুদী যেহেতু সঠিক পথে ছিল তাই বিচারও গেল তার পক্ষে। কিন্তু বিশ্র তা না মেনে হযরত উমর রা. এর কাছে পুনরায় বিচারাবেদন করল, ওমর রা. যখন জানতে পারলেন- বিশ্র রাসূল সা. এর বিচার না মেনে, রাসূল সা. এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করে তাঁর নিকট পুনরায় বিচার তলব করেছে, তখন তিনি তরবারী দিয়ে বিশ্র এর গর্দান উড়িয়ে দিলেন। (তাফসীরে তাবারী)

এতে বোঝা গেল ইসলামী খিলাফতের আমীরের প্রতি আনুগত্য না করাও মুনাফিকের একটি নিদর্শন।

পবিত্র কুরআনের অন্য এক আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন: “আর আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ মান্য কর এবং তাঁর রাসূলের। তাছাড়া তোমরা পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হয়োনা। যদি তা কর, তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে পড়বে। এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য ধারণ কর নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা আনফাল- ৪৬)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জিহাদ চলাকালীন মুসলমানদের করণীয় কি হবে? এ বিষয়ে তিনটি কর্মসূচী ঘোষণা করেন। (১) সুদৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী থাকবে। (২) বেশি বেশি আল্লাহকে স্বরণ করবে। (আনফাল- ৪৫)

উপর্যুক্ত আয়াতে তৃতীয় কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। তা হলো (৩) আমীরের আনুগত্য। কেননা আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থন শুধুমাত্র আনুগত্যের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। পক্ষান্তরে পাপ ও আনুগত্যহীনতা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিতির কারণ হয়ে থাকে। সাধারণত আনুগত্যহীনতা আসে পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হলে, তাই উক্ত আয়াতে পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। সাথে সাথে এর ক্ষতির দিকও বর্ণনা করা হয়েছে যে, বিবাদে লিপ্ত হলে নিজেরা কাপুর“ষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ তখন হীনমন্যতা কাজ করবে। আর এতে করে দুশমন থেকে নিজেদের প্রভাব বিনষ্ট হবে। অতপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিবাদ থেকে বেঁচে থাকার সূক্ষ্ম একটি উপায় নির্দেশ করেছেন। তা হলো ‘সবর’ তথা ধৈর্য। একমাত্র ধৈর্যের মাধ্যমেই সবকিছুর সমাধান হয়ে যায়। কেননা আমীরের ফায়সালা যদি হয় তখনও একমাত্র উপায় হচ্ছে ধৈর্য। ধৈর্যের গুণ যার থাকবে আল্লাহর সাহায্য তার সাথী হবে। তার দ্বারা কারো অনিষ্ট সাধিত হবেনা। (মা’আরিফুল কুরআন-মুফতী শফি রহ.) পবিত্র কুরআনে অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-“আমি মানুষকে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জোর প্রচেষ্টা চালায় যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করোনা।” (সূরা আনকাবুত- ৮)

অন্যায় বা ফাসিকীর ক্ষেত্রে কোন আনুগত্য নেই; উক্ত আয়াতে তাই বোঝানো হয়েছে। হযরত সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. এর ইসলাম গ্রহনে তার মা ক্রুদ্ধ হয়ে অনশন করলে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। একটি হাদিসের মাধ্যমে এ বিষয়টি আরো সুদৃঢ় হয়েছে। হাদিসে রাসূল সা. বলেন: আমীর বা উর্ধ্বতন যে কোন ব্যাক্তির আনুগত্য ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে যতক্ষণ তিনি আল্লাহর আনুগত্যের গণ্ডির ভেতরে থাকবেন। আল্লাহর নাফরমানির ক্ষেত্রে আনুগত্য হারাম।